Friday, November 22, 2024
Homeধর্মরমজানে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ের শিক্ষা

রমজানে আল্লাহ ও বান্দার হক আদায়ের শিক্ষা


মতামতঃ

পবিত্র রমজান হলো সিয়াম সাধনা ও আত্মশুদ্ধির মাস। এ মাসে পবিত্র কুরআন নাযিল হয়েছে। মূলতঃ পবিত্র কুরআনের ঐশী বানীর কারণেই রমজানের এতো মর্যাদা। রমজানের উদ্দেশ্যই হলো- স্রষ্টা ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি মানুষের দায়িত্ব-কর্তব্য জাগ্রত করা। আমরা জানি, বান্দার হক ও আল্লাহর হক আদায়ের নামই হচ্ছে ইসলাম। ইসলাম মানবাধিকারের সীমা এত প্রশস্ত করেছে যে পুরো জীবন এর মধ্যে এসে পড়ে। এর মধ্যে রয়েছে- বাবা-মার হক, বন্ধু-বান্ধবের হক, শ্রমিক-মালিক এবং শাসক ও জনগণের হক, সরকারের হক, শ্রমজীবী মানুষের হক, দুর্বল ও অসহায়দের হক, সাধারণ মানুষের হক ইত্যাদি। রাসুলুল্লাহ স. বলেন- ‘বান্দার উপর আল্লাহর হক হলো- একমাত্র তাঁরই ইবাদাত করবে এবং তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করবে না। আর আল্লাহর উপর বান্দার হক হলো- যে তাঁর সঙ্গে কাউকে শরিক করে না তাকে শাস্তি না দেয়া।’ আমরা আজকের নিবন্ধে পবিত্র রমজানে মহান আল্লাহ ও তাঁব বান্দা তথা সৃষ্টির প্রতি মানুষের হকগুলি সম্পর্কে জানব। ইন শা আল্লাহ।

আত্মশুদ্ধির মাস রমাদান। আরবি ‘তাযকিয়াতুন নুফুস’ এর বাংলা পরিভাষা আত্মশুদ্ধি। রমাদান মাসে যে ব্যক্তি নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে পারলো না; তার সিয়াম পালন অর্থহীন। শাব্দিকভাবে তায্কিয়া’র অর্থ হলো পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ও পবিত্র হওয়া। যেমন পবিত্র কুরআনের সূরা তাওবা’র ১০৩ নং আয়াতে বলা হয়েছে, ‘তাদের সম্পদ থেকে সাদাকা নাও, এর মাধ্যমে তাদেরকে তুমি পবিত্র ও পরিশুদ্ধ করবে।’ এছাড়া তায্কিয়া’র আর একটি অর্থ হলো বৃদ্ধি পাওয়া। যেমন ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ রুকন যাকাতকে এ উভয় অর্থের বিবেচনায় যাকাত বলা হয়। কারণ যাকাত আদায়ের মাধ্যমে অবশিষ্ট সম্পদ পরিশুদ্ধ এবং বরকতপ্রাপ্ত হয়ে বৃদ্ধি পায়।

পরিভাষায় ‘তায্কিয়া’ বলতে ব্যক্তির নফসকে শিরক-বিদয়াত ও অন্যান্য পাপাচারসহ সব ধরণের কলুষতাপূর্ণ কাজ থেকে বিরত রাখা এবং উত্তম চরিত্রের মাধ্যমে নিজের আত্মাকে সজ্জিত করা বুঝায়। পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘নিঃসন্দেহে সে সফলকাম হয়েছে, যে নিজকে পরিশুদ্ধ করেছে, এবং সে ব্যর্থ হয়েছে যে তার নাফ্স (অন্তরাত্মা)-কে কলুষিত করেছে।’ (সূরা শামস ৯-১০)
রমজান বা রমাদান আরবি শব্দ। রমাদান শব্দের অভিধানগত অর্থ হলো প্রচ- গরম, উত্তপ্ত বালু বা মরুভূমি, পুড়ে যাওয়া, ঝলসে যাওয়া, জ্বর, তাপ ইত্যাদি। রমজানে ক্ষুধা-তৃষ্ণায় রোজাদারের পেটে আগুন জ্বলে; পাপতাপ পুড়ে ছাই হয়ে রোজাদার নিষ্পাপ হয়ে যায়; তাই এ মাসের নাম রমজান। (লিসানুল আরব)।

মহানবী স. এর অমীয় বানী-‘এটি (রমাদান) সংযমের মাস আর সংযমের ফল হচ্ছে জান্নাত।’ (মিশকাত) আরবি মাসসমূহের নবম মাস হচ্ছে পবিত্র রমজান মাস। রোজা হচ্ছে ইসলামের তৃতীয় স্তম্ভ। রোজা শব্দটি ফারসি। এর আরবি পরিভাষা হচ্ছে সওম, বহুবচনে বলা হয় সিয়াম। সওম অর্থ বিরত থাকা, পরিত্যাগ করা। পরিভাষায় সওম হলো আল্লাহর সন্তুটি কামনায় সুবহে সাদিক থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত নিয়তসহকারে পানাহার থেকে বিরত থাকা। রোজা ফরজ হয় দ্বিতীয় হিজরির শাবান মাসে। রমাদানের রোজা ফরজ হওয়ার অন্যতম কারণ হচ্ছে তাকওয়া তথা আল্লাহভীতি অর্জন। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনের সুরা বাকারার ১৮৩ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে, হে মুমিনগণ! তোমাদের প্রতি রোজা ফরজ করা হয়েছে যেমন ফরজ করা হয়েছিল তোমাদের পূর্ববর্তীদের প্রতি, যাতে তোমরা আল্লাহভীরু হতে পারো, পরহেজগার হতে পারো।’ এ আয়াত থেকে আমরা বুঝতে পারি, রোজার বিধান দেওয়া হয়েছে তাকওয়া অর্জনের জন্য, গুনাহ বর্জন করে আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের মাধ্যমে জান্নাতের উপযোগী হওয়া, নিজেকে পরিশুদ্ধ করার জন্য।

সিয়াম পালন একটি দৈহিক ও আত্মিক ইবাদত। দিনের একটি দীর্ঘসময় দৈহিক প্রয়োজন থেকে দূরে থাকার মাধ্যমে সহিষ্ণুতার প্রশিক্ষণ দেয় রোজা। শুধু আল্লাহর ভয়ে লোকচক্ষুর আড়ালেও পানাহার থেকে বিরত থাকে একজন রোজাদার। এভাবে শারীরিক কু-প্রবৃত্তির ক্ষমতা দুর্বল হয়ে আত্মিক শক্তি বৃদ্ধি পায়। দুনিয়ায় বিলাসিতার মোহ কমে আখেরাতের প্রতি মনোযোগী হওয়ার সুযোগ ঘটে। এভাবে রোজা একজন মানুষকে উত্তম চরিত্রের অধিকারী নৈতিকতাসম্পন্ন মুমিন হিসেবে গড়ে তোলে। প্রকৃত মুমিনের যে প্রধান নৈতিক গুণাবলি পবিত্র কোরআনে উল্লেখ করা হয়েছে, তার মধ্যে অন্যতম হলো আমানত রক্ষা করা। ইরশাদ হয়েছে, ‘আর যারা নিজেদের আমানত ও অঙ্গীকারের প্রতি যতœবান।’ সুরা মুমিনুন : ৮

এ প্রসঙ্গে হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু হুরায়রা (রা.) সূত্রে বর্ণিত, হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি তোমার কাছে আমানত রেখেছে, তার আমানত তাকে ফেরত দাও। আর যে ব্যক্তি তোমার আমানতের খেয়ানত করেছে, তুমি তার আমানত খেয়ানত করো না।’ সুনানে আবু দাউদ : ৩/৩৫৩৫
এখানে লক্ষণীয় বিষয় হলো, কোরআনে কারিমে আমানতের বিষয়টিকে ‘আমানাত’ বহুবচনে উল্লেখ করা হয়েছে। এতে ইঙ্গিত দেওয়া হয়েছে, কারও কাছে অপর কারও বস্তু কিংবা কোনো সম্পদ গচ্ছিত রাখাটাই শুধু আমানত নয়, যাকে সাধারণত আমানত বলে অভিহিত করা হয়। বরং আল্লাহর হক (শরিয়তের যাবতীয় বিধান) ও বান্দার হক সম্পর্কিত সবকিছুই এর অন্তর্ভুক্ত হবে। মুত্তাকি মুমিনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ গুণ হচ্ছে, অঙ্গীকার রক্ষা করা। পবিত্র কোরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘হে মুমিনরা! তোমরা অঙ্গীকারগুলো পূর্ণ করো।’ সুরা মায়িদা : ১

ওয়াদা ভঙ্গ করা মুনাফিকের আলামত। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে হজরত রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘মুনাফিকের আলামত তিনটি। ১. কথা বললে মিথ্যা বলে, ২. ওয়াদা করলে তা ভঙ্গ করে, ৩. তার কাছে আমানত রাখা হলে সে খেয়ানত করে।’ সহিহ বোখারি : ৩৩

এ ছাড়া প্রকৃত মুমিন হওয়ার জন্য সততা, ন্যায়পরায়ণতা, উদারতা, মহানুভবতা, সহিষ্ণুতা, ক্ষমাশীলতা প্রভৃতি নৈতিক গুণে গুণান্বিত হওয়া আবশ্যক। রমজান মাসে মানুষের কথাবার্তা, আচার-আচরণ, লেনদেন ও কাজ-কারবার নিয়ন্ত্রণের মাধ্যমে সেই গুণাবলি অর্জনের দিকনির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত হাদিসে রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে ব্যক্তি (রোজা রেখে) পাপ, মিথ্যা কথা, অন্যায় ও মূর্খতাসুলভ কাজ ত্যাগ করে না, তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোনো প্রয়োজন নেই।’ সহিহ বোখারি : ১৯০৩
অন্য হাদিসে এসেছে, হজরত রাসুলুল্লাহ স. বলেন, ‘রোজা হচ্ছে (মানুষের জন্য দোজখের আগুন থেকে আত্মরক্ষার) ঢালস্বরূপ। সুতরাং যখন তোমাদের কারও রোজার দিন আসে, সে যেন অশ্লীল কথা না বলে এবং অনর্থক আওয়াজ না করে। যদি কেউ তাকে গালি দেয় অথবা তার সঙ্গে ঝগড়া করতে চায়, সে যেন তাকে বলে দেয়, আমি একজন রোজাদার।’ সহিহ বোখারি : ১৮৯৪ এভাবে দীর্ঘ একটি মাস সিয়াম সাধনার মাধ্যমে আত্মসংশোধনের পথ সুগম হয় এবং কলুষমুক্ত অনাবিল সমাজ লাভের নিশ্চয়তা পাওয়া যায়।

মহান আল্লাহ পবিত্র কুরআনে ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ইবাদত করো আল্লাহর, তার সঙ্গে কোনো কিছুকে শরিক করো না। আর সদ্ব্যবহার করো মাতা-পিতার সঙ্গে, নিকটাত্মীয়ের সঙ্গে, এতিম, মিসকিন, নিকটাত্মীয়-প্রতিবেশী, অনাত্মীয়-প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সাথি, মুসাফির এবং তোমাদের মালিকানাভুক্ত দাস-দাসীদের সঙ্গে। নিশ্চয়ই আল্লাহ পছন্দ করেন না, তাদের যারা দাম্ভিক, অহংকারী।’ সুরা আন নিসা : ৩৬
হাদিস শরিফে নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়ায় অপরের একটি প্রয়োজন মিটিয়ে দেবে, পরকালে আল্লাহ তার ১০০ প্রয়োজন পূরণ করে দেবেন এবং বান্দার দুঃখ-দুর্দশায় কেউ সহযোগিতার হাত বাড়ালে আল্লাহ তার প্রতি করুণার দৃষ্টি দেন।’ সহিহ্ মুসলিম : ২৫৬৬

অভাবী মানুষকে সহায়তা করা, তাদের তরে নিজেকে বিলিয়ে দেওয়া, বস্ত্রহীনকে পোশাক-আশাক দিয়ে সহায়তা করাও সওয়াবের কাজ। হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, হজরত আবু সাঈদ খুদরি (রা.) বলেন, নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘কোনো মুসলমান অপর মুসলমানকে বস্ত্রহীনতায় বস্ত্র দিলে আল্লাহপাক তাকে জান্নাতের সবুজ বস্ত্র পরাবেন।’ সুনানে তিরমিজি : ২৮৩৫

অন্নহীনকে খাবার দেওয়াও হাক্কুল ইবাদের অন্যতম বৈশিষ্ট্য। হাদিসে এ প্রসঙ্গে ইরশাত হয়েছে, ‘তোমরা ক্ষুধার্তকে খাদ্য দাও, অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নাও, বস্ত্রহীন লোকদের বস্ত্র দাও এবং বন্দিকে মুক্ত করে দাও।’ সহিহ্ বোখারি : ২৪১৭তিনি আরও বলেছেন, ‘নিশ্চয়ই ওই ব্যক্তি পূর্ণ মুমিন নয়, যে নিজে পেট পুরে আহার করে। কিন্তু তার প্রতিবেশী ক্ষুধার্ত থাকে।’ বায়হাকি : ৩৩৮৯

হযরত আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসুল (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘একজন মুসলমানের ওপর অন্য মুসলমানের ছয়টি হক আছে । প্রশ্ন করা হলো, হে আল্লাহর রাসুল! সেগুলো কী কী? তিনি বলেন, (এক) সাক্ষাতে সালাম বিনিময় করা। (দুই) আমন্ত্রণ করলে গ্রহণ করা। (তিন) উপদেশ চাইলে উপদেশ দেওয়া। (চার) হাঁচি দিয়ে ‘আলহামদুলিল্লাহ’ বললে জবাবে ‘ইয়ারহামুকাল্লাহ’ বলা। (পাঁচ) অসুস্থ হলে সাক্ষাৎ করে খোঁজ-খবর নেওয়া। (ছয়) মৃত্যুবরণ করলে জানাজায় উপস্থিত হওয়া। ’ (মুসলিম, হাদিস : ৪০২৩)
আসুন পবিত্র রমজানে নিজেকে পরিশুদ্ধ করতে সচেষ্ট হই। সৃষ্টিকর্তা আল্লাহ তায়ালা ও তাঁর সৃষ্টির প্রতি আমাদের হক তথা অধিকারগুলো আদায়ে রমজানের শিক্ষা এবং পবিত্র কুরআনের নির্দেশনা মেনে চলি। (আমিন)

লেখক : প্রভাষক বিলাল মাহিনী
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়-ঢাকা ও নির্বাহী সম্পাদক, ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।
bhmahini@gmail.com

RELATED ARTICLES

Most Popular