ইসরাত জাহানঃ
জীবন রক্ষাকারী উপাদান নিয়ে যাদের সংগ্রাম তারাই ফার্মাসিস্ট। এই ফার্মাস্টিদের ছাড়া চিকিৎসা ব্যবস্থা কল্পনাই করা যায় না, কেননা পুরো চিকিৎসা বিজ্ঞানই অসম্পূর্ণ থেকে যেত যদি না ফার্মাসিস্ট তৈরী হতো।
অসংখ্য অণুজীবে পরিপূর্ণ এই মহাবিশ্বের প্রাণীদের দেহে কতই না রোগসৃষ্টি হয়। এত এত জীবাণু নিয়ে কাজ করা এই ফার্মাসিস্টরা এতোদিন যেন ছিল পর্দার আড়ালের প্রকৃত মহানায়ক। তবে, দিন পাল্টেছে প্রকৃত নায়কদের গুরুত্ব উপলব্ধি হয়েছে। সেখান থেকেই ২০১০ সালে প্রথমবারের মতো পালিত হয় দিবসটি। বাংলাদেশ অবশ্য একটু দেরী করেই তা বুঝতে পারে। তাইতো, স্বাস্থ্যহিরো ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর হাত ধরে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে সাভারের গণ বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৪ সালে প্রথমবারের মতো দিবসটি পালন হয়।
সময়ের পরিক্রমায় আবারো এসেছে ২৫ সেপ্টেম্বর। বিভিন্ন দ্বন্দ্ব, ভিন্ন রাজনীতি ও সংস্কৃতি এবং অর্থনৈতিক বৈষম্যসহ সব বাধা কাটিয়ে স্বাস্থ্যের জন্য ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বানে এবার পালিত হচ্ছে দিবসটি।
বিশ্বায়নের এ যুগে ফার্মেসি কিংবা ফার্মাসিস্ট অনেক এগিয়েছে তবে, প্রকৃতির সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্ব কিংবা মানুষের সঙ্গে মানুষের দ্বন্দ্বের যে খেলা চলেছে তা যেন পর্দার টম এন্ড জেরি। যখন প্রকৃতির সঙ্গে মানুষ নিজেদের পেশি শক্তি দেখায় তখন প্রকৃতিও নিজেদের শক্তি চেনায়। এই যেমন মহামারী ভাইরাস গুলো। এর মধ্যে সাম্প্রতিক সময়ে করোনা ভাইরাস অন্যতম। আবার, মানুষ যখন নিজেদের মধ্যে লড়াইয়ে লিপ্ত হয় তখনও লেলিয়ে দেয় অতিক্ষুদ্র অণুজীবদের আধিপত্য। এইসব খেলায় যেন ঘাম ঝরে এই ফার্মাসিস্টদেরই। নিত্যনতুন ঔষুধে তারা নিজেরা হেরে জিতিয়ে দেয় নেগেটিভ এনার্জিকে।
ফার্মাসিস্টদের লড়াই এন্টিমাইক্রোবিয়াল রেজিস্টেন্ট এর বিরুদ্ধেও। এন্টিবায়োটিক এর মতো জীবন রক্ষার সর্বোচ্চ গুরুত্বপূর্ণ ঔষুধের অতি ব্যবহার কিংবা সঠিক ডোজ ব্যবহার না করার ফলে জীবনের নিভিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ঠেকাতেও ভাবতে হচ্ছে প্রতিনিয়ত।
একজন ডাক্তার রোগ নির্ধারণ করে ঔষুধ দেন কিন্তু রোগ ও রোগীর ধরণ অনুযায়ী মাথা খাটিয়ে সেই ঔষুধ বের করেন একজন ফার্মাসিস্ট। ফার্মাসিস্টরা যেমন ওষুধ তেরি করে, ফার্মেসী পেশার কাজ করে এবং বৈজ্ঞানিক গবেষণার সাথেও ওতোপ্রোতভাবে জড়িত থাকে। সুতরাং, ফার্মেসী নিঃসন্দেহে আমাদের বিশ্বস্ত সঙ্গী। বাংলাদেশে বেশিরভাগ ওষুধ গুলো বিক্রি হয় ফার্মাসিস্টদের পরামর্শে। অধিকাংশ রোগীর প্রথম পরামর্শক একজন ফার্মাসিস্ট। কেননা একজন রোগী ফার্মাসীতে যাওয়ার পরে শুনতে পারে রোগের নামগুলো যেমন, ডায়বেটিস, গর্ভবতীর সংবাদ এছাড়াও আরো বিভিন্ন ধরনের রোগ সম্পর্কে ধারণা পায়।
তবে, ফার্মাসিস্টদের এত এত সফলতার ভিড়ে দুঃখের গল্প যেন লুকিয়ে গেছে মহাকালের গর্বে। এটা, যেমন দেশের সাধারণ জনগণের দুঃখ তেমন ফার্মাসিস্টদেরও। নকল ঔষুধ, মানহীন ঔষুধ, ঔষুধের দাম বৃদ্ধি, মেয়াদউত্তীর্ণ ঔষুধের ব্যবহার, ঔষুধের প্রয়োগের অপব্যবহার, সঠিক যাচাই-বাছাইয়ের অভাবে কতই না দুর্ঘটনা ঘটেছে দেশে। এবার আসি ফার্মাসিস্টদের কথায়, যারা নিজেদের জীবন বাজি রেখে অন্যদের জীবন বাঁচায় তারাই থাকে অন্ধকারের অন্তরালে। সুযোগ-সুবিধা, নিরাপত্তা, অসুস্থ হলে চিকিৎসা সেবা, ভাতা, উন্নত জীবনমান সবটাই তাদের থেকে বঞ্চিত।
বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসী বিভাগ থেকে শুরু করে বিভিন্ন বড় বড় ফার্মাসিইটিক্যালস, ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তর এবং বড় বড় জেলাগুলো খুব উৎসাহের সাথে র্যালি বের করা থেকে শুরু করে, স্বেচ্ছায় রক্তদান করেন, সেমিনার এবং জনসচেতনতা মূলক কার্যক্রম এবং সাথে বিভিন্ন ধরণের অনুষ্ঠান করে তবে এই বিষয়গুলো নিয়ে যেন কেউ কথা বলেন না।
তবে, গর্বের বিষয় হচ্ছে। ব্লাক হোল সব আলো শোষণ করতে পারেনি। মুক্তিযোদ্ধা, সমাজ সেবক, চিকিৎসক, নারী উন্নয়নের অগ্রযাতক গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর মত আলো গুলো এখনো বেঁচে আছে, লড়াই করতেছেন। জাতীয় ঔষুধ নীতির প্রববর্তক এই মানুষটি ঔষুধের দাম, মান নিয়ে যা করেছেন সত্যিই অপূর্ব। উনার গণস্বাস্থ্য ফার্মাসিউটিক্যালসের ঔষুধ এখনো সুলভ মূল্যে বিক্রয় হয়, মানের বিষয়ে তো কথাই নাই। বড় বড় দুর্যোগুলোতে দেওয়া হয় ফ্রিতে চিকিৎসা, ঔষুধ। গরিবদের জন্য তো অনেক কমে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করেছেন। গণ বিশ্ববিদ্যালয়ের ফার্মেসি বিভাগে অনেক কম খরচে ফার্মাসিস্ট তৈরীর ব্যবস্থা করেছেন। এত এত সুযোগ-সুবিধা আর পড়াশোনার মান, শিক্ষাব্যবস্থার এতই সুব্যবস্থা করেছেন যা বাংলাদেশের ইতিহাসে বিরল।
এতকিছুর বাহিরে, ফার্মাসিস্ট কেন্দ্রীক আরো অনেক সমস্যা রয়েছে। যেমন, সরকারি কর্মক্ষেত্রে এখনো ফার্মাসিস্টদের সুব্যবস্থার সুযোগ হয়নি। দেশে প্রতি বছর সাড়ে ৩ থেকে ৪ হাজার গ্র্যাজুয়েট ফার্মাসিস্ট বের হলেও তাদের ৮০ ভাগই সরাসরি ওষুধ উৎপাদনে কাজ করছেন। হাসপাতাল বা ফার্মেসিতে কাজের সুযোগ না থাকায় প্রতি মাসেই দেশ ছাড়ছেন বিশাল সংখ্যাক ফার্মাসিস্ট। এত এত ফার্মাসিস্ট বের হওয়ার পরও সরাসরি স্বাস্থ্যসেবায় কাজে না লাগাতে পারার ঘটনায় হতাশা প্রকাশ করেছেন বিশেষজ্ঞরা। স্বাস্থ্যসেবার প্রটোকলে ফার্মাসিস্টের উপস্থিতি নিশ্চিত করতে না পারলে রোগীরা সবসময় বিশ্বমানের সেবা থেকে বঞ্চিত থাকবে বলে আশঙ্কা তাদের।
তবে, আর যাই হোক, ফার্মাসিস্টরা তাদের লড়াই জারী রেখেছে। দেশ, জাতী ও বিশ্বের জন্য তারা অনবদ্য ভূমিকায় অবতীর্ণ ছিল, থাকবে। তাদের জন্য লম্বা একটা লাল সালাম।
লেখকঃ শিক্ষার্থী ফার্মেসি বিভাগ, গণ বিশ্ববিদ্যালয়।