— বিলাল হোসেন মাহিনী
মানব সভ্যতা প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে মিলেমিশে বেড়ে উঠে। তাই প্রাকৃতিক পরিবেশের বাইরে গেলে মানব সভ্যতা হুমকিতে পড়ে। বর্তমানে মানবসৃষ্ট নানা দূষণ-দহনে প্রকৃতি তার ভারসাম্য হারাচ্ছে। এ সকল দূষণের মধ্যে প্লাস্টিক ও পলিথিন সবচেয়ে বেশি ক্ষতিকর। প্লাস্টিক দূষণে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির জায়গায় রয়েছে শিশুরা। কারণ গবেষণায় স্পষ্ট যে, প্রাপ্তবয়স্কদের তুলনায় বাচ্চাদের মলে প্রায় দশগুণ বেশি মাইক্রো প্লাস্টিক পাওয়া যাচ্ছে বর্তমানে। তার মানে তাদের শরীরেও ব্যাপক হারে প্রবেশ ঘটছে এই বিষাক্ত বস্তুর। পরিবেশবিদ ও বিজ্ঞানীদের মতে, প্লাস্টিক ও পলিথিনের ব্যবহার এখনই বন্ধ না করলে ২০৪০-৫০ সালে এই পৃথিবীতে প্লাস্টিক বর্জ্য বেড়ে যাবে প্রায় দ্বিগুণ। তখন মনুষ্যশরীরে এই ‘প্লাস্টিক’রূপী ভাইরাসের দাপট কি থামানো যাবে? পানির বোতল, খাবারের প্যাকেট, দুধের প্যাকেট থেকে শুরু করে ফেসওয়াশ, কসমেটিক্স, এমনকি প্রাণদায়ী ওষুধও এখন বিতরণ হচ্ছে প্লাস্টিক কন্টেনারে। আর বাজারের নিত্যপণ্য সবই তো পলিথিনে ভরে দেয়া হয়।
ব্যক্তি থেকে শুরু করে প্রতিটি পরিবার থেকে পলিথিন ও প্লাস্টিক ব্যবহারে অনাস্থা জ্ঞাপন করা দরকার। প্রাথমিক পর্যায় থেকে যেমন প্লাস্টিকের ব্যবহার বন্ধ করা প্রয়োজন, তেমনি সরকারেরও হস্তক্ষেপ জরুরী। সরকার প্রণীত নিয়ম ছাড়া প্লাস্টিক দূষণ বন্ধ করা কষ্টকল্পনা। গবেষণায় জানা যায়, প্রতিবছর মাথাপিছু প্রায় পাঁচ কেজি প্লাস্টিক দ্রব্যাদি ব্যবহৃত হয়। পত্র-পত্রিকার খবর মতে, বাংলাদেশে প্লাস্টিক দ্রব্যাদির বাজার প্রায় ১ বিলিয়ন ডলারের। আর প্লাস্টিক উৎপাদকারী প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় ৪ হাজার। ২০ লাখেরও বেশি লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে প্লাস্টিক ও পলিথিন উৎপাদন ও বিপনণের সাথে জড়িত। তথ্যমতে, ঢাকা শহরে প্রতিদিন ১ কোটি ২০ লাখ পলিব্যাগ পরিত্যক্ত হয়। আর তা পুকুর, ডোবা, নদী-নালা ও সাগরে গিয়ে জমা হয়। কৃষকের চাষের জমি, পুকুর, রাস্তাঘাট ভরে যাচ্ছে প্লাস্টিক বর্জ্য।ে বিশ্বে প্রতি মিনিটে প্রায় ৫ লাখ প্লাস্টিক বোতল বিক্রি হচ্ছে। বিবিসি নিউজ বলছে, বিশ্বজুড়ে এখন বছরে ৮০ লাখ টন প্লাস্টিক ও পলিথিন বর্জ্য সাগরে গিয়ে পড়ে, ২০৫০ সাল নাগাদ বছরে এর পরিমাণ হবে ১ লাখ ৩০ হাজার টন (আনুমানিক)।
পরিবেশ বিষয়ক গবেষণা সংস্থা এনভায়রনমেন্ট এ্যান্ড সোশ্যাল ডেভেলমেন্ট অর্গানাইজেশন কর্তৃক বাংলাদেশে প্লাস্টিক ও পলিথিন পণ্যের ব্যবহার নিয়ে ২০১৮ ও ২০১৯ সালে পরিচালিত এক জরিপে দেখা গেছে, তরুণ ও যুবকরাই প্লাস্টিক দূষণের জন্য বেশি দায়ী। যেসব খাবারের সঙ্গে প্লাস্টিকের প্যাকেট রয়েছে, সেগুলোর বেশিরভাগের ভোক্তা ১৫ থেকে ৩৫ বছরের তরুণ-তরুণী। দেখা যায়, মাত্র কয়েক দশক আগেও আমাদের স্বাভাবিক জীবনচিত্র ছিল প্রকৃতি আর প্রাকৃতিক উপাদনের উপর নির্ভরশীল। বাজার থেকে মাছ বা মাংস আনার জন্য ছিল কাপড় বা চটের থলি কিংবা কঞ্চি দিয়ে বোনা কলস আকৃতির খালোই, তেল আনতো গলায় দড়ি বাঁধা কাচের শিশিতে, আইসক্রিম নামক রঙিন বরফ ধরার জন্য থাকত বাঁশের কাঠি। কলাপাত ও পদ্মপাতার ব্যবহার ছিল চোখে পড়ার মতো।
বিয়ে, কুলখানিসহ বিভিন্ন উৎসব-অনুষ্ঠানে খাওয়ার জন্য থাকতো কলাপাতা, কোথাও বা পদ্মপাতা। গরম ভাত-তরকারির ভাপে ভরা সবুজ পাতা থেকে অদ্ভুত সুন্দর গন্ধ ছড়াত। দৈনন্দিন জীবন-যাপনের অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে ওঠা প্লাস্টিক পলিথিনে পানি, বাতাস এবং মাটিকে প্রতিনিয়ত দূষিত করে জল-স্থল তথা পৃথিবীতে বসবাসকারী অসংখ্য প্রাণী-উদ্ভিদের জীবন বিপন্ন করে তুলছে। অবিবেচকের মতো মাত্রাহীন প্লাস্টিক ও পলিথিন ব্যবহার শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত সর্বত্র বিপর্যস্থ করে তুলেছে।
বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর। ০১৮৪৩-৯০৪৭৯০