বিলাল হোসেন মাহিনী :
কবিগুরু লিখেছেন-
‘এসো এসো, এসো হে বৈশাখ।/ তাপস নিশ্বাস বায়ে মুমূর্ষুরে দাও উড়ায়ে, /বৎসরের আবর্জনা দূর হয়ে যাক।
যাক পুরতন স্মৃতি, যাক ভুলে-যাওয়া গীতি/ অশ্রুবাষ্প সুদূরে মিলাক’-
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এভাবে ফেলে আসা বছরের গ্লানি মুছে নতুনকে স্বাগত জানিয়েছেন। সব চাওয়া-পাওয়া, আশা-নিরাশা পেছনে ফেলে বাংলা ১৪২৯ সাল কালের স্রোতে লীন হয়েছে। ১৪৩০ সালের শুভাগমনের মধ্য দিয়ে নতুন প্রভাতের সূচনা হলো। স্বাগত বাংলা নববর্ষ। নববর্ষ বাঙালির ইতিহাস-ঐতিহ্যের অচ্ছেদ্য অংশ। বলা বাহুল্য, বাংলা সন ও নববর্ষ উদযাপন মূলত মুসলিম ঐতিহ্যজাত এবং মুসলিম শাসকরাই তা প্রবর্তন করেন। বাংলা সনের সঙ্গে বাংলার শাসনব্যবস্থার সংস্কারে মুসলমান শাসকদের ঐতিহাসিক অবদান রয়েছে।
আমার প্রিয় বাংলাদেশে নানা জাতি, গোষ্ঠী ও ধর্ম-বর্ণের মানুষ সারা বছর নানা উৎসব পালন করে থাকে। ঈদ, পূজা, রমজান, বাংলা নববর্ষ থেকে শুরু করে পারিবারিক অনুষ্ঠানসমূহ বেশ হৃদিক পরিবেশেই পালিত হয় এ দেশে। ভারতে মুঘল শাসন প্রতিষ্ঠার পর শাসকরা খাজনা ইত্যাদি হিজরি তারিখ অনুযায়ীই তুলতেন। মোগল স¤্রাট আকবর দ্বিতীয় পানিপথের যুদ্ধে হিমুচন্দ্র বিক্রমাদিত্যের বিশাল বাহিনীকে পরাজিত করে সিংহাসনে আরোহনের ঐতিহাসিক দিন থেকে হিজরী সনকে ভিত্তি করে বাংলা নববর্ষের সূচনা হয়। বঙ্গ, আসাম তথা প্রাচীনকাল থেকে বর্তমান বাংলাদেশ, ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মণিপুর ইত্যাদি অঞ্চলে বর্ষবরণের আনুষ্ঠানিক প্রচলন ছিল। কৃষিকাজ, ফসল তোলা, বাণিজ্যিক লেনদেন, হালখাতা ইত্যাদিকেন্দ্রিক ছিল সে অনুষ্ঠানগুলো।
বাংলা সনের ইতিকথা : দিল্লী সালতানাতের সময়ে হিজরি বর্ষপঞ্জি অনুসরণ করা হলেও কৃষিভিত্তিক সমাজ বাস্তবতায় হিজরি বর্ষপঞ্জিতে কর আদায়ের ক্ষেত্রে কিছু অসামঞ্জস্য দেখা দেয়ায় একটি নতুন সনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই প্রেক্ষাপটে ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে মুঘল সম্রাট আকবর হিজরি সনের ভিত্তিতে বাংলা বর্ষপঞ্জি প্রবর্তনের নির্দেশ দেন। মুঘল রাজদরবারের দার্শনিক ও জ্যোতির্বিজ্ঞানী ফতেহ্উল্লাহ সিরাজী হিজরি সন ও সৌর সনের সমন্বয় করে বাংলা সন প্রবর্তন করেন। মুঘল আমলে প্রবর্তিত বাংলা বর্ষপঞ্জিতেও কিছু সমস্যা দেখা দেয়ায় ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ বাংলা বর্ষপঞ্জিতে কিছু সংস্কার আনেন। তার সংস্কার অনুসারে এখন প্রতিবছর ১৪ এপ্রিলে বাংলাদেশে পহেলা বৈশাখে বর্ষবরণের উৎসব হয়ে থাকে। আমাদের রয়েছে একটি নিজস্ব ক্যালেন্ডার, যা জাতি হিসেবে আমাদের সমৃদ্ধ ও গর্বিত করেছে। এ কারণেই আমাদের জাতীয় জীবনে বাংলা নববর্ষের গুরুত্ব অত্যন্ত বেশি। ১৫৫৬ খ্রিষ্টাব্দের ১০ই মার্চ বা ৯৯২ হিজরিতে বাংলা সন গণনা শুরু হয়। তবে এই গণনা পদ্ধতি কার্যকর করা হয় স¤্রাট আকবরের সিংহাসন আরোহণের সময় (৫ই নভেম্বর, ১৫৫৬) থেকে। প্রথমে এই সনের নাম ছিল ফসলি সন, পরে “বঙ্গাব্দ” বা বাংলা বর্ষ নামে পরিচিত হয়।
শামসুজ্জামান খানের মতে, বাংলার মুঘল সুবাদার মুর্শিদ কুলি খান প্রথম পুন্যাহ এর রীতি শুরু করেন, যার অর্থ হচ্ছে “ভূমি রাজস্ব আদায়ের উৎসবের দিন”, এবং তিনি বাংলা দিনপঞ্জির সূচনা করার জন্য আকবরের রাজস্বের নীতি ব্যবহার করেন। শামসুজ্জামান খান ও নীতিশ সেনগুপ্তের মতে বাংলা দিনপঞ্জির উদ্ভব পরিষ্কার নয়। শামসুজ্জামান এর মতে, “একে বাংলা সন বা সাল বলা হত, যা যথাক্রমে আরবি ও ফারসি শব্দ। এটা নির্দেশ করছে যে এটি প্রথম কোন মুসলিম রাজা বা সুলতানের দ্বারা প্রচলিত হয়েছে।” অন্যদিকে সেনগুপ্তের মতে, এর ঐতিহ্যগত নাম হচ্ছে বঙ্গাব্দ।
বাংলা বর্ষবরণে ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ : পত্র-পত্রিকা ও ইতিহাস সূত্রে জানা যায়, ১৯৮৬ খ্রিষ্টাব্দে চারুপীঠ নামের একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান যশোরে প্রথমবারের মতো নববর্ষ উপলক্ষে ‘আনন্দ শোভাযাত্রার’ আয়োজন করে। যশোরের সেই শোভাযাত্রায় ছিল – পাপেট, বাঘের প্রতিকৃতি, পুরানো বাদ্যযন্ত্রসহ আরো অনেক শিল্পকর্ম। শুরুর বছরেই যশোরে শোভাযাত্রা আলোড়ন তৈরি করে। পরবর্তীতে যশোরের সেই শোভাযাত্রার আদলেই ঢাকার চারুকলা থেকে শুরু হয় বর্ষবরণ ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’।
১৯৮৯ সালে প্রথম ঢাবি’র চারুকলা ইনস্টিটিউট থেকে নববর্ষ উপলক্ষে ‘আনন্দ শোভাযাত্রা’ বের করা হয়। পরবর্তীতে তা ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ নামে প্রচলিত হয়। ঢাকার বৈশাখী উৎসবের একটি আবশ্যিক অঙ্গ ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে পহেলা বৈশাখের সকালে এই শোভাযাত্রাটি বের হয়ে শহরের বিভিন্ন সড়ক প্রদক্ষিণ করে পুনরায় চারুকলা ইনস্টিটিউটে এসে শেষ হয়। এই শোভাযাত্রায় গ্রামীণ জীবন এবং আবহমান বাংলাকে ফুটিয়ে তোলা হয়। শোভাযাত্রায় সকল শ্রেণী-পেশার বিভিন্ন বয়সের মানুষ অংশগ্রহণ করে। শোভাযাত্রার জন্য বানানো হয় বিভিন্ন রঙের মুখোশ ও বিভিন্ন প্রাণীর প্রতিকৃতি। জাতিসংঘের অঙ্গসংস্থা ইউনেস্কো বাংলাদেশ সরকারের সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের আবেদনক্রমে ২০১৬ খ্রিষ্টাব্দের ৩০শে নভেম্বর বাংলাদেশের ‘‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’’কে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ণ অধরা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করে।
নববর্ষ উদযাপন বাঙালির শত বছরের ঐতিহ্য হলেও ‘মঙ্গল শোভাযাত্রা’ হাজার বছরের ঐতিহ্য নয়। এটার উৎপত্তি ১৯৮৯ সনে। সুতরাং নিজেদের মেকি পা-িত্য জাহির করতে এটাকে হাজার বছরের বাঙালি ঐতিহ্য বলে চালিয়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। বরং বর্ষবরণে আমাদের করণীয় হলো-
ক) সুস্থ সাংস্কৃতিক ধারা গড়ে তোলা। খ) পান্তা ইলিশের নামে শাহি খাবার আর অপচয় করে গরিবদের সাথে উপহাস না করা। কেননা, অতীতে নববর্ষে পান্তা-ইলিশের কোনো রেওয়াজ খুঁজে পাওয়া যায় না। কারণ, এই সময় তো ইলিশের মৌসুম নয়। গ) নববর্ষের নামে নানা সংগঠনের নামে চাঁদাবাজি বন্ধ করা। ঘ) বিনোদন মাধ্যমগুলোতে দেশীয় কৃষ্টি-কালচারকে প্রাধান্য দেয়া। নববর্ষের নামে পার্ক ও ক্যাম্পাসগুলোতে যুবক-যুবতীদের নগ্নতা, বেহায়াপনা ও অবৈধ অবাধ মেলামেশা বন্ধ করা। ঙ) পত্র-পত্রিকা, বেতার, টিভিতে বাঙালির আত্মপরিচয় ও শেকড় কী তা নিয়ে নিবন্ধ-প্রবন্ধ লেখা চ) বাঙালির মা, মাটি ও বিশ্বাসের সাথে সঙ্গতি রেখে লোকজ ও নিরেট বাঙালি সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা। ছ) নববর্ষ উপলক্ষ্যে কৃষিমেলা, শিল্প মেলা, বইমেলা, কবিতা উৎসব, দেশ-প্রাণ-প্রকৃতির গান, চিত্রাঙ্কন ও হাতের লেখা প্রতিযোগিতার আয়োজন করা। জ) খেলাধুলা ও শিক্ষণীয় সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা যেতে পারে। জাতীয় কবির ভাষায়-‘ঐ নুতনের কেতন ওড়ে,/ কাল বৈশাখীর ঝড়/ তোরা সব জয়ধ্বনি কর।’ ঝ) এছাড়াও প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও কালবৈশাখী ঝড়ের ক্ষতিকর দিক থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য সেমিনার, সিম্পোজিয়াম ও আলোচনা সভার আয়োজন করা যায়।
বাংলা নববর্ষ বারবার ফিরে আসুক বাঙালির জাতীয় জীবনে। সুখ সুন্দর শান্তির বার্তা বিলিয়ে বাঙালির প্রতিটি প্রাণ মিলুক এক প্রাণে। এই প্রত্যাশায়…।
বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর। ০১৯২২-৯৬৮২৯২