Friday, November 15, 2024
Homeনির্বাচিতভালো কাজের প্রতিদান ও মন্দ কাজের শাস্তি

ভালো কাজের প্রতিদান ও মন্দ কাজের শাস্তি

মৃত্যু পরবর্তী জীবনে মানুষের একমাত্র পাথেয় হলো দুনিয়াতে করে যাওয়া তার ভালো কাজ তথা আমলে সালেহ সমূহ। নেক আমল বা আমলে সালেহ এর বাংলা অর্থ হলো ভালো কাজ বা সৎ কাজ। সৃষ্টি ও স্রষ্টার কল্যাণে কৃত কাজগুলোই মানুষকে দুনিয়া ও আখিরাতে সম্মানিত করে, মহৎ করে। মানুষের সৎ কর্মই তার পাপরাশিকে জ্বালিয়ে দেয়। একইভাবে অসৎ কাজ মানুষকে কলুষিত করে। অসম্মানিত ও অপমানিত করে। মন্দ কাজের প্রতিদান স্বরূপ মানুষ দুনিয়া ও আখিরাতে লঞ্চিত এবং কঠোর শাস্তির সম্মুখিন হয়। আসুন আমরা ভালো কাজের প্রতিদান ও মন্দ কাজের শস্তিসমূহ জেনে নিই।

‘আমল’ মানে- কর্ম ও আচরণ। আর ‘সালেহ’ শব্দের অর্থ হলো ভালো, উত্তম, উৎকৃষ্ট, সৎ, সঠিক, যথার্থ, গ্রহণযোগ্য, আল্লাহ নির্দেশিত, সর্বজন স্বীকৃত ন্যায্য ও বাস্তব। সাধারণত কুরআনের অনুবাদে আমলে সালেহ অর্থ করা হয়, ‘নেক আমল’ বা ‘ভালো কাজ’ বা ‘সৎ কাজ’। আমলে সালেহ ব্যাপক অর্থবোধক বাক্য যার রয়েছে বহুল বিস্তারিত অর্থ। শান্তি স্থাপন, সমঝোতা স্থাপন, মিলে মিশে চলা, নিষ্পত্তি করে নেয়া, মধ্যপন্থা অবলম্বন করা। সমঝোতা করে চলা, সন্ধি স্থাপন করা। মীমাংসা করে নেয়া, সংযমশীল হওয়া ইত্যাদি আমলে সালেহ এর বৈশিষ্ট্য।

আমলে সালেহ-এর ভিত্তি হলো ঈমান। ঈমান ছাড়া ভালো কাজের ফল লাভ করা যাবেনা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ঈমান এনে যেকোনো পুরুষ বা নারী আমলে সালেহ (সৎ কাজ) করবে, আমি তাকে দান করবো উত্তম পবিত্র জীবন এবং তাদের পুরস্কার দেবো তাদের সবচেয়ে ভালো কাজগুলোর ভিত্তিতে। (সূরা আন-নহল : আয়াত ৯৭) আমলে সালেহকে তখনই সৎ কাজ বলা হবে, যখন সেই কাজের মধ্যে- ইলম, (একথা জানা যে, এ কাজে আল্লাহর সন্তুষ্টি ও হুকুম রয়েছে) সবর, নিয়্যাত ও আন্তরিকতা থাকবে।

‘‘আর যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে ‘আর তা তাদের রবের পক্ষ হতে (প্রেরিত) সত্য, তিনি তাদের থেকে তাদের মনদ কাজগুলো দূর করে দেবেন এবং তিনি তাদের অবস্থা সংশোধন করে দেবেন।’’ (সূরা মুহাম্মাদ : আয়াত ২) পবিত্র কুরআনে আরও বলা হয়েছে, ‘‘আর যারা ঈমান এনেছে, সৎকর্ম করেছে এবং মুহাম্মাদের প্রতি যা নাযিল করা হয়েছে তাতে বিশ্বাস স্থাপন করেছে ‘আর তা তাদের রবের পক্ষ হতে (প্রেরিত) সত্য, তিনি তাদের থেকে তাদের মনদ কাজগুলো দূর করে দেবেন এবং তিনি তাদের অবস্থা সংশোধন করে দেবেন।’’ (সূরা আত-তাগাবুন : আয়াত ৯) ‘‘সুতরাং যারা ঈমান আনে ও সৎকর্ম করে, তাদের জন্য রয়েছে ক্ষমা ও সম্মানজনক রিযিক্ব।’’ (সুরা হাজ্ব : আয়াত ৫০)

অসৎ কাজের শাস্তি :
যে কেউ অসৎ কাজ করবে অথবা মানুষের বা সমাজের ক্ষতি করবে, তাকে দুনিয়া ও আখিরাতে পীড়াদায়ক শাস্তি ভোগ করতে হবে। হজরত আবু সিরমাহ রা. থেকে বর্ণিত, রাসুল সা. বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি অন্যের ক্ষতি করে আল্লাহ তা দিয়েই তার ক্ষতি করেন। আর যে ব্যক্তি অন্যকে কষ্ট দেয়, আল্লাহও তাকে কষ্ট দেন।’ (সুনানে আবু দাউদ : ৩৬৩৫)

উপরে বর্ণিত হাদিস ইসলামি শরিয়তের দুটি মূলনীতিকে প্রমাণ করে। এক. মানুষের কাজের ওপর তার ভালো ও মন্দ প্রতিদান নির্ভর করে। দুই. অন্যের ক্ষতি করা ও নিজে ক্ষতিগ্রস্থ হওয়া ইসলামে নিষিদ্ধ। প্রতিদান মানুষের কাজের অনুরূপ হওয়া মহান আল্লাহর প্রজ্ঞা ও ন্যায়বিচারের নীতির অনুরূপ। আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনের একাধিক স্থানে মানুষের প্রতিদান তার কাজের অনুরূপ হবে বলে ঘোষণা দিয়েছেন। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘কেউ অণু পরিমাণ ভালো কাজ করলে সে তা দেখবে এবং কেউ অণু পরিমাণ মন্দ কাজ করলে সে তাও দেখবে।’ (সুরা জিলজাল : আয়াত ৭-৮)
অর্থাৎ পরকালে মানুষের সব কাজ দৃশ্যমান হবে এবং তার কাজের অনুরূপ প্রতিদান দেওয়া হবে। হাদিসে এসেছে, যে ব্যক্তি আল্লাহর পছন্দনীয় কাজ করে আল্লাহ তাকে ভালোবাসেন আর যে ব্যক্তি আল্লাহর অপছন্দনীয় কাজ করে আল্লাহ তার ওপর ক্ষুব্ধ হন।

একইভাবে বলা হয়েছে, যে ব্যক্তি মুসলমানের প্রতি সহজ আচরণ করবে, আল্লাহ তার জন্য দুনিয়া ও আখিরাত সহজ করবেন। আর যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের দুনিয়ার একটি কষ্ট দূর করে দেয়, আল্লাহ তার কিয়ামতের কষ্ট দূর করে দেবেন। রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুমিনের পার্থিব দুঃখ-কষ্ট দূর করবে, আল্লাহ কিয়ামতে তার দুঃখ-কষ্ট দূর করবেন। যে ব্যক্তি কোনো সংকটাপন্ন ব্যক্তির সংকট নিরসন করবে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার যাবতীয় সংকট নিরসন করে দেবেন। যে ব্যক্তি কোনো মুসলিমের দোষ-ত্রুটি গোপন রাখে, আল্লাহ দুনিয়া ও আখেরাতে তার দোষ-ত্রুটি গোপন রাখবেন। আর আল্লাহ ততক্ষণ পর্যন্ত বান্দার সাহায্য করে থাকেন, যতক্ষণ পর্যন্ত বান্দা নিজ ভাইয়ের সাহায্যে রত থাকে।’(সহিত মুসলিম ও তিরমিজি)

উপরোক্ত হাদিসের ব্যাখ্যায় বলা যায়, অন্যের ক্ষতি দুই প্রকার। ক. যা শান্তিও স্বস্তি নষ্ট করে। খ. যা কোনো প্রকার অপকার করে। কোনো মুমিনের জন্য মানুষের ক্ষতি করা ও মানুষের জন্য ক্ষতিকর কাজ করা বৈধ নয়; এমন কাজ থেকে বেঁচে থাকা আবশ্যক। ইসলামের দৃষ্টিতে বহু বিষয় ক্ষতিকর জিনিসের আওতাভুক্ত। যেমন, লেনদেনে ধোঁকা দেওয়া, প্রতারণা করা, পণ্যের ত্রুটি গোপন করা, ষড়যন্ত্র করা, প্রবঞ্চনা, অস্বাভাবিক বা দ্বিগুণ লাভ করা, মুসলিম ভাইয়ের বেচাকেনার ওপর বেচাকেনা করা ইত্যাদি। এসব বিষয়ের কিছু শরিয়ত কর্তৃক সরাসরি নিষিদ্ধ আরও কিছু কাজের ব্যাপারে ইসলাম নিরুৎসাহিত করেছে। এমনকি অসৎ উদ্দেশ্যে বৈধ কোনো কাজ করতেও ইসলাম নিষেধ করে। যেমন, ওয়ারিশদের মধ্যে কাউকে ক্ষতিগ্রস্থ করার জন্য অসিয়ত করা। পবিত্র কুরআনে ইরশাদ হয়েছে, ‘এটা যা অসিয়ত করা হয় তা দেওয়ার এবং ঋণ পরিশোধের পর যদি কারও জন্য ক্ষতিকর না হয়।’ (সুরা নিসা : আয়াত ১২)
আমরা জানি, ইসলামের শাস্তি ও প্রতিদানের বিধান শুধু পার্থিব জীবনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট নয়; বরং পরকালেও তা প্রতিফলিত হবে। মহান আল্লাহ বলেন, ‘যারা মুমিন পুরুষ ও মুমিন নারীদের কষ্ট দেয় এমন কিছুর জন্য যা তারা করেনি; তারা অপবাদের ও স্পষ্ট পাপের বোঝা বহন করে।’ (সুরা আহজাব : আয়াত ৫৮)

পার্থিব জগতে কোন পাপের কী শাস্তি হয়, এ প্রসঙ্গে ইসলামের শ্রেষ্ঠতম তাফসিরবিদ আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত আছে, তিনি বলেছেন, ‘কোনো জাতির মধ্যে আত্মসাৎ করা বৃদ্ধি পেলে সে জাতির লোকদের অন্তরে ভয়ের সঞ্চার করা হয়। কোনো জাতির মধ্যে ব্যভিচার ছড়িয়ে পড়লে সেখানে মৃত্যুর হার বৃদ্ধি পায়। কোনো সম্প্রদায়ের লোকেরা পরিমাপ ও ওজনে কম দিলে তাদের রিজিক সংকুচিত করা হয়। কোনো জাতির লোকেরা অন্যায়ভাবে বিচার-ফয়সালা করলে তাদের মধ্যে রক্তপাত বিস্তৃতি লাভ করে। কোনো জাতি প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ করলে আল্লাহ শত্রুদের তাদের ওপর (শাসক হিসেবে) চাপিয়ে দেন।’ (মুয়াত্তা মালেক, হাদিস নম্বর : ১৩২৩)

দুনিয়া ও আখিরাতের জীবনে সফলতা লাভের জন্য সৎ কাজ করা ও মন্দ কাজ থেকে নিজেকে বাচিঁয়ে রাখা মানুষের অন্যতম দায়িত্ব। তাই আসুন আমরা পরস্পর মানুষের কল্যাণে কাজ করি। ভালো কাজে প্রতিযোগিতা করি। মন্দ কাজ থেকে দূরে থাকি। আল্লাহ আমাদের সহায় হোন। আমিন।

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর । নির্বাহী সম্পাদক- ট্রু নিউজ২৪.নেট, যুগ্ম সম্পাদক- ভৈরব-চিত্রা রিপোর্টার্স ইউনিটি। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট। কাজের ক্ষেত্র : কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা।
bhmahini@gmail.com

RELATED ARTICLES

Most Popular