Saturday, November 23, 2024
Homeমতামতচলমান সময়ে পরমত চিন্তা ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা

চলমান সময়ে পরমত চিন্তা ও ধর্মের প্রতি শ্রদ্ধা

মতামতঃ

এই পৃথিবীর প্রতিটি মানুষ ও মানব গোষ্ঠীর চিন্তা, মত, ধর্ম-দর্শন আলাদা। মানুষ সৃষ্টির সেরা জীব। তাই ভিন্ন মত, পথ ও ধর্ম-দর্শনের প্রতি নিজের চিন্তা ও দর্শনের মতোই শ্রদ্ধা রাখা জরুরি। কেননা, কোনো ধর্ম-ই সাম্প্রদায়িকতা শেখায় না। আর যারা সাম্প্রদায়িক চিন্তা পোষণ করে এবং সে মতে কর্মকা- পরিচালনা করে তাদের কোনো ধর্ম নেই; বরং তারা উগ্র সম্প্রদায়িক। বিশ্বনবীও সাম্প্রদায়িকতাকে কঠোরভাবে ঘৃণা করতেন। মহান আল্লাহ তায়ালাও সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে পবিত্র আল-কুরআনে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথকে সঠিক মত ও পথ থেকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে’ (সূরা বাকার, আয়াত ২৫৬)। সুতরাং ‘তোমাদের (তাদের) ধর্ম তোমাদের (তাদের) জন্য, আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য’ (সূরা কাফিরুন, আয়াত ৫)। ইসলামে অপর ধর্মের উপাসনালয় ভাঙ্গা বা ক্ষতিসাধন করা দূরে থাক, কোনোরূপ ক্ষতি সাধনের চিন্তা করাও হারাম। পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের (দেবদেবীর) আরাধনা করে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না (গালি দিও না)। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গাল-মন্দ করবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজ-কর্মকে সুশোভিত করে দিয়েছি। অতপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদের বলে দেবেন যা কিছু তারা করত।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১০৮) বরং সংখ্যাগরিষ্ট মুসলিমদের দায়িত্ব হলো, অপর ধর্মের উপাসনালয় পাহারা দেওয়া, যাতে তারা স্বাচ্ছন্দে আরাধনা বা প্রার্থনা করতে পারে।

একইভাবে পরমতের প্রতি শ্রদ্ধা থাকাও অপরিহার্য। অপরের দোষত্রুটি তথা ছিদ্রান্বেষণ করা হারাম করেছে ইসলাম। রাসুল সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো সম্প্রদায়ের কথা গুপ্তভাবে শুনল; অথচ সে তাদের কথাগুলো শুনুক তারা তা পছন্দ করছে না অথবা তারা তার অবস্থান টের পেয়ে তার থেকে দূরে পালিয়ে যাচ্ছে, কিয়ামতের দিন এ জন্য তার কানে সিসা ঢেলে দেওয়া হবে।’ (সহীহ বুখারি, হাদিস : ৭০৪২)

মানুষের ব্যক্তিগত পাপাচার ও দোষ অনুসন্ধান করা, ক্ষতি করা, ব্যক্তিগত স্বার্থ অর্জনের জন্য কারো পেছনে লেগে থাকা ও গোয়েন্দাগিরি করা নিষিদ্ধ। লুকিয়ে কারো কথা শোনা, ঘরের ভেতর উঁকি দেওয়া, ফেসবুকের আইডি হ্যাক করা, পাসওয়ার্ড চুরি করা, ইনবক্স চেক করা, গোপনীয়ভাবে কারো ছবি তোলা, ভিডিও ধারণ করা, কথা রেকর্ড করা ইত্যাদি হারাম। অপর হাদিসে কথাটি আরো সুস্পষ্ট হয়ে ফুটে উঠেছে, ‘হে লোকেরা, তোমরা যারা মুখে ইসলাম গ্রহণ করেছো; অথচ ঈমান তোমাদের অন্তরে ঢোকেনি, তোমরা মুসলমানদের কষ্ট দিয়ো না। তাদের দোষ অনুসন্ধান করো না। কারণ যে ব্যক্তি তার কোনো মুসলিম ভাইয়ের দোষ অনুসন্ধান করল, আল্লাহ তাআলা তার দোষ অনুসন্ধান করবেন। আর যার দোষ আল্লাহ তায়ালা অনুসন্ধান করবেন তাকে অবশ্যই তিনি লাঞ্ছিত করে ছাড়বেন, যদিও সে নিজ ঘরের অভ্যন্তরেই অবস্থান করুক না কেন।’ (তিরমিজি, হাদিস নং : ২০৩২)

দোষ গোপন রাখায় আছে পুরস্কার রয়েছে। মানুষের দোষ গোপন রাখা মহৎ কাজ। আল্লাহ তাআলা দোষ-ত্রুটি গোপনকারীর দোষ গোপন করেন। তাকে উভয় জগতে পুরস্কৃত করেন। মানবতার নবী মুহাম্মদ সা. বলেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো মুসলমানের দোষ গোপন রাখে আল্লাহ তাআলা কিয়ামতের দিন তার দোষ ঢেকে রাখবেন।’ (তিরমিজি, হাদিস নং ২৯৪৫)

পরস্পর ক্ষতিসাধনে লিপ্ত হলে বিপর্যয়ে ছেয়ে যায় মানুষের জীবনযাপন। ছিদ্রান্বেষণকারীর অত্যাচারে শান্তি-স্বস্তিতে থাকতে পারে না ব্যক্তি। আল্লাহ তাআলা মানুষের দোষ অনুসন্ধান ও ব্যক্তির পেছনে অকারণে গোয়েন্দাগিরি করতে নিষেধ করেছেন। ইসলামে অন্যের দোষ অনুসন্ধান ও মন্দ ধারণা করা পাপ। আল্লাহ বলেন, ‘হে ঈমানদাররা, তোমরা বেশি অনুমান থেকে বেঁচে থাকো। কারণ কিছু কিছু অনুমান তো পাপ এবং তোমরা কারোর গোপনীয় দোষ অনুসন্ধান করো না।’ (সুরা : হুজরাত, আয়াত : ১২)

অনুরূপভাবে অন্য ধর্মের প্রতি জুলুম করা বা জোর জবরদস্তি করাও হারাম। দ্বীনের (ধর্ম বা জীবন ব্যবস্থার) ব্যাপারে কোনো জবরদস্তি বা বাধ্যবাধকতা নেই। (সুরা বাকারা ২৫৬) কারণ, ইসলামের মূল উৎস কুরআন এবং হাদিস পরধর্মের মানুষকে আপনের চেয়েও বেশি শ্রদ্ধা ও সম্মান করতে শিখিয়েছে। আমরা দেখেছি আমাদের নবী সা.-এর আপনজনের অনেকেই ছিল ইসলামের কট্টর দুশমন। তথাপিও নবী সা. তাদের প্রতি নির্যাতন তো দূরের কথা কখনো প্রতিবাদও করেননি। বরং কোন বিরোধী যখন অসুস্থ হতো তখন রাসূল সা. তাকে দেখতে যেতেন। রাসূলের আন্তরিকতায় ওই বিরোধীরাও কালেমার পতাকাতলে আশ্রয় নিত। এই যখন মুসলমানের নবীর চরিত্র, তাহলে তারা কীভাবে মন্দিরে হামলা করতে পারে? একজন প্রকৃত মুসলমানের পক্ষে মন্দির ভাঙ্গা তো দূরের কথা মন্দির ভাঙ্গার চিন্তা করাও সম্ভব নয়। কারণ, ইসলামের নবী মুহাম্মাদ সা. বলেছেন, ‘যারা মানুষকে সাম্প্রদায়িকতার দিকে ডাকে, সাম্প্রদায়িকতার জন্য যুদ্ধ করে, সংগ্রাম করে এবং জীবন উৎসর্গ করে তারা আমাদের দলভুক্ত নয়’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং ৫১২৩)।

‘আল্লাহকে ছেড়ে তারা যাদের (দেবদেবীর) আরাধনা করে, তোমরা তাদেরকে মন্দ বলো না (গালি দিও না)। তাহলে তারা ধৃষ্টতা দেখাতে গিয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গাল-মন্দ করবে। এমনিভাবে আমি প্রত্যেক সম্প্রদায়ের দৃষ্টিতে তাদের কাজ-কর্মকে সুশোভিত করে দিয়েছি। অতপর স্বীয় পালনকর্তার কাছে তাদের প্রত্যাবর্তন করতে হবে। তখন তিনি তাদের বলে দেবেন যা কিছু তারা করত।’ (সুরা আনআম : আয়াত ১০৮)
উক্ত আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসিরে জালালাইনে বলা হয়েছে- ‘আল্লাহ তাআলা বলেন-‘আল্লাহকে ছেড়ে যাদেরকে (যেসব প্রতিমাসমূহকে) তারা ডাকে তাদেরকে তোমরা গালি দিও না। তাহলে তারা অজ্ঞানতাবশত (আল্লাহ তাআলা সম্পর্কে তাদের অজ্ঞনতার কারণে) সীমালঙ্ঘন করে (অন্যায়ভাবে ও সীমাতিক্রম করে) আল্লাহকে গালি দেবে!

ইসলামে সাম্প্রদায়িকতার ব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছে পবিত্র কুরআন। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘ধর্মের ব্যাপারে জোরজবরদস্তি নেই। ভ্রান্ত মত ও পথকে সঠিক মত ও পথ থেকে ছাঁটাই করে আলাদা করে দেয়া হয়েছে’ (সূরা বাকার, আয়াত ২৫৬)। সুতরাং ‘তোমাদের ধর্ম তোমাদের জন্য, আমাদের ধর্ম আমাদের জন্য’ (সূরা কাফিরুন, আয়াত ৫)। একে অন্যের ধর্ম পালন করতে গিয়ে কেউ কোনরূপ সীমালঙ্ঘন কিংবা বাড়াবাড়ি করবে না। অন্য কেউ যদি ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি করেও ফেলে তবে ভুলেও যেন কোন ইমানদার এ ধরনের হীন ও জঘন্য কাজের সঙ্গে নিজেকে সম্পৃক্ত না করে। এ বিষয়টিই নসিহতস্বরূপ মুমিনদের উদ্দেশে আল্লাহ তায়ালা বলছেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তারা আল্লাহকে বাদ দিয়ে যেসব দেবদেবীর পূজা-উপাসনা করে, তোমরা তাদের গালি দিও না। যাতে করে তারা শিরক থেকে আরো অগ্রসর হয়ে অজ্ঞতাবশত আল্লাহকে গালি দিয়ে না বসে’ (সূরা আনআ’ম, আয়াত ১০৮)। যেখানে অন্য ধর্মের দেবতাকে গালি দেওয়া নিষিদ্ধ সেখানে মন্দির ভাঙচুর ও মানুষ হত্যা কীভাবে বৈধ হতে পারে?

প্রকৃত মুসলমান কখনোই ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অনুভূতিতে আঘাত আসে এমন কোন কাজ করতে পারে না। রাসূল সা. বলেছেন, ‘কোনো মুসলমান যদি ভিন্ন ধর্মাবলম্বীদের অধিকার ক্ষুন্ন করে কিংবা তাদের ওপর জুলুম করে, তবে কেয়ামতের দিন আমি মুহাম্মাদ ওই মুসলমানের বিরুদ্ধে আল্লাহর আদালতে লড়াই করব’ (আবু দাউদ, হাদিস নং ৩০৫২)’ তিনি সা. আরো বলেছেন, ‘অন্যায়ভাবে কোন অমুসলিমকে হত্যাকারী জান্নাতের সুঘ্রাণও পাবে না। অথচ চল্লিশ বছরের রাস্তার দূরত্ব থেকেই ওই ঘ্রাণ পাওয়া যাবে’ (সহি বুখারি, হাদিস নং ৩১৬৬)। অন্য বর্ণনায় এসেছে, ‘যে ব্যক্তি কোন অমুসলিকে অন্যায়ভাবে হত্যা করবে আল্লাহ তায়ালা তার জন্য জান্নাত হারাম করে দেবেন’ (সুনানে নাসায়ী, হাদিস নং ৪৭৪৭)। রাসূল সা. ও খোলাফায়ে রাশেদীনের চিরাচরিত নিয়ম ছিল, যখন কোন সেনাবাহিনী প্রেরণ করার প্রয়োজন হত তারা বিভিন্ন নসিহতের পাশাপাশি এ নসিহতটি অবশ্যই করতেন যে, ‘যুদ্ধকালীন সময়ে বা যুদ্ধের পর কোন মন্দির-গীর্জা-উপাসনালয় ভেঙ্গে ফেলবে না’ (মুসান্নাফ আবী শায়বা : ৩৩৮০৪)।

দেখুন বিশ্বনবী ও তাঁর সাহাবায়ে কেরাম যুদ্ধকালীন সময়েও পর ধর্মের কোনো উপাসনালয় ভাঙ্গতে নিষেধ করেছেন। আর কিছু নামধারী অজ্ঞ মূর্খ ও সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠী ধর্মের নামে বিভেদ সৃষ্টি করে দেশে ও সমাজে অশান্তি সৃষ্টির পাঁয়তারা করছে। আসুন বাঙালি হিসেবে এবং সর্বোপরি সৃষ্টির সেরা জীব ‘মানুষ’ হিসেবে আমরা পরস্পরের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হই। অপরের দোষ-ত্রুটি খোঁজা তথা ছিদ্রান্বেষণ থেকে দূরে থাকি। শান্তির সমাজ বিনির্মানে পরমতসহিষ্ণু হই।

বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।

RELATED ARTICLES

Most Popular