Saturday, November 23, 2024
Homeমতামতশান্তিদূত মহানবী (সা.)

শান্তিদূত মহানবী (সা.)

মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা.-কে পৃথিবীবাসীর জন্য শান্তির দূত হিসেবে প্রেরণ করেছেন। কিন্তু সেই শান্তি ম্লান হচ্ছে, আজকের সমাজে কিছু নামধারী মুসলিম (প্রকৃতপক্ষে যাদের মধ্যে দ্বীনের মৌলিক জ্ঞান নেই) তারা অশান্তির পথে চলার ফলে সমাজে অশান্তি ও নৈরাজ্য সৃষ্টি হচ্ছে। ইসলাম ধর্মের নামকরণ হয়েছে ‘সিলম’ ও ‘সালাম’ শব্দ থেকে। যার অর্থ ‘শান্তি ও নিরাপত্তা’। সালামই এ ধর্মের পরিচয় ও নিদর্শন। শান্তিই এর আহ্বান ও পথ-পন্থা। সালামের এ ধর্মই আল্লাহ তা‘আলা তাঁর বান্দাদের জন্য মনোনীত করেছেন। তিনি বলেন, ‘আজ আমি তোমাদের জন্যে তোমাদের দ্বীনকে পূর্ণাঙ্গ করে দিলাম, তোমাদের প্রতি আমার অবদান সম্পূর্ণ করে দিলাম এবং ইসলামকে তোমাদের জন্যে দ্বীন হিসেবে পছন্দ করলাম।’ [সূরা মায়িদা : ০৩]

রাসুলুল্লাহ সা. জিহ্বা ও হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছে। তিনি বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলিম হল সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৬) তিনি আরও বলেন, ‘যার অসদাচরণ থেকে প্রতিবেশী নির্ভয় ও নিরাপদ থাকতে পারে না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৩)

সর্বশেষ ও সর্বশ্রেষ্ঠ নবী মুহাম্মদ সা. ছিলেন শান্তি ও সালামের পতাকাবাহী। তাঁর আদর্শ ও সুন্নত ছিল, তিনি নিজের সালাত শেষ করামাত্র তাঁর উম্মতকে মনে করিয়ে দিতেন, শান্তি আল্লাহর নিয়ামত এবং সেটি প্রত্যাশা ও প্রদান করা হয় আল্লাহর পক্ষ থেকে। এজন্য তিনি সালাম ফিরিয়ে বলতেন : ‘আল্লাহুম্মা আনতাস সালাম ওয়া মিনকাস সালাম, তাবারাকতা ইয়া যাল-জালালি ওয়াল ইকরাম। অর্থ : হে আল্লাহ! তুমি শান্তিময়, তোমার কাছ থেকেই শান্তি অবতীর্ণ হয়। তুমি বরকতময়, হে পরাক্রমশালী ও মর্যাদা প্রদানকারী।’ (মুসলিম ১/২১৮, আবু দাউদ ১/২২১, তিরমিযী ১/৬৬)
সহীহ হাদিস গ্রন্থ বুখারিতে বর্ণিত হয়েছে, ‘হুদায়বিয়া নামক স্থানে গিয়ে নবীজি সা. এর উটনী কাসওয়া বসে পড়ল।’ কুরাইশের কাফেররা আল্লাহর রাসূল সা. এর ওমরা আদায়ে বাঁধা হয়ে দাঁড়াল। তিনি তখন বললেন, ‘সেই সত্তার কসম, যাঁর হাতে আমার প্রাণ, কুরাইশরা আল্লাহর সম্মানিত বিষয়গুলোর মধ্যে যে কোনো বিষয়ের সম্মান প্রদর্শনার্থে কিছু চাইলে আমি তা পূরণ করব।’ তিনি আরও বললেন, ‘আমরা যুদ্ধ করতে আসিনি। বরং আমরা এসেছি ওমরা করতে।’ তথাপি কুরাইশরা তাঁকে হারাম শরিফে ঢুকতে বাঁধা দেয়। তখন তিনি তাদের সঙ্গে একটি সন্ধি চুক্তিতে স্বাক্ষর করেন, যা থেকে শান্তি ও সালাম প্রতিষ্ঠায় তাঁর আগ্রহ ফুটে ওঠে। ‘আর যদি তারা সন্ধি করতে আগ্রহ প্রকাশ করে, তাহলে তুমিও সে দিকেই আগ্রহী হও এবং আল্লাহর ওপর ভরসা কর। নিঃসন্দেহে তিনি শ্রবণকারী; পরিজ্ঞাত।’ (সূরা আনফাল : ৬১)

রাসূল সা. এর সুরভীত জীবন চাক্ষুস সাক্ষ্য, তিনি যুদ্ধ বা সংঘাতের প্রতি ডাকেননি। ঝগড়া বা বিবাদের দিকে আহ্বান জানাননি বরং তিনি ছিলেন দয়ার্দ্র, উদার ও ক্ষমাপ্রবণ। মক্কায় দাওয়াতের সূচনাসময়ে যখন তাঁর জাতি তাঁকে অসহ্য যাতনা দিচ্ছে, তাঁর কাছে পাহাড়ের ফেরেশতা এলেন। অনুমতি চাইলেন মক্কার দুই পাহাড়কে মিলিয়ে কোরাইশ কাফেরদের পিষে মারতে। তখন তিনি শান্তি ও সালামই বেছে নেন। বলে ওঠেন : ‘বরং আমি আশা করি আল্লাহ তাদের বংশ থেকে এমন ব্যক্তিদের বের করবেন যারা এক আল্লাহর ইবাদত করবে এবং তাঁর সঙ্গে শরিক করবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)

এই পৃথিবীতে মানুষের জীবনে শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্যই ইসলামী ব্যবস্থা মানুষের মধ্যে পারস্পরিক ভালবাসা, সহমর্মিতা, সহযোগিতা, সুসম্পর্ক বজায় রাখা এবং ঐক্যবদ্ধ জীবনযাপনকে অপরিহার্য করে দিয়েছে। পক্ষান্তরে যেসব বিষয় মানুষের মধ্যে বিভেদ, অনৈক্য, হিংসা- বিদ্বেষ, জিগাংসা, হানাহানি, খুন খারাবি, হতাশা, বঞ্চনা, শোষণ, নিপীড়ন এবং সাধারণ ও স্বাভাবিক সম্পর্কের মধ্যে চিড় ধরায়, ইসলাম এ সকল বিষয়কে কঠোরভাবে নিষেধ করেছে এবং হারাম ঘোষণা করেছে। তাই ইসলামের সাথে সন্ত্রাসবাদ বা জঙ্গিবাদসহ যে কোন ধরনের ধ্বংসাত্মক কর্মকান্ডের কোনই সম্পর্ক নেই।

বর্তমানে ইসলামের মৌলিক জ্ঞান সম্পর্কে অজ্ঞজনেরা ইসলাম ধর্ম নিয়ে বিভিন্ন রকমের অপপ্রচার চালাচ্ছে। সে কারণে সরাসরি কুরআন ও সুন্নাহ থেকে ইসলামের সততা ও স্বচ্ছতা সম্পর্কে সংক্ষিপ্তাকারে কয়েকটি নির্দেশনা তুলে ধরা হলো :

ইসলাম মানুষের কল্যাণকে প্রাধান্য দিয়েছে, মানবতার কল্যাণের অন্যতম দিক হলো শান্তি ও নিরাপত্তা প্রতিষ্ঠা। এ দায়িত্ব মুসলিম জাতির ওপর ন্যস্ত। যারা এ দায়িত্ব পালন করবে আল্লাহ তাদেরকে শ্রেষ্ঠ জাতি হিসেবে ঘোষণা করেছেন। তিনি বলেন, ‘তোমরাই শ্রেষ্ঠ জাতি, তোমাদের বাছাই করা হয়েছে মানবতার কল্যাণের জন্য।’ (সূরা আলে ইমরান: ১১০)

কুরআন সৎপথ প্রদর্শনকারী। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘নিশ্চয়ই এ কুরআন হিদায়াত করে সেই পথের দিকে, যা সুদৃঢ় এবং সৎ কর্মপরায়ণ মুমিনদেরকে সুসংবাদ দেয় যে, তাদের জন্য রয়েছে মহাপুরস্কার। আর যারা আখেরাতের উপর ঈমান রাখে না, আমরা তাদের জন্য বেদনাদায়ক শাস্তি তৈরি করে রেখেছি।’ (সূরা বনী ইসরাঈল: ৯-১০)

ইসলাম মাতা-পিতা, আত্মীয়-স্বজন, গরীব-মিসকীন তথা সকল মানবের সাথে সদ্ব্যবহারের নির্দেশ প্রদান করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘তোমরা ইবাদাত কর, আল্লাহর আর তার সাথে কাউকে শরীক করো না, পিতা-মাতা, আত্মীয়-স্বজন, ইয়াতীম, মিসকীন, নিকটাত্মীয় প্রতিবেশী, অনাত্মীয় প্রতিবেশী, পার্শ্ববর্তী সহচর পথিক এবং তোমাদের ডান হাত যাদের অধিকারী তাদের সাথে সদ্ব্যবহার কর। নিশ্চয়ই আল্লাহ অহঙ্কারী ও আত্মাভিমানীকে ভালবাসেন না।’ (সূরা নিসা: ৩৬)

ইসলাম অন্যায়ভাবে কাউকে হত্যা করতে ও কারো সম্পদ আত্মসাৎ করতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অন্যায়ভাবে পরস্পরে একজন আরেকজনের ধন-সম্পদ ভক্ষণ করো না, তবে পারস্পরিক সম্মতিতে ব্যবসা বাণিজ্যের মাধ্যমে (যা উপার্জিত হয় তা ভক্ষণ করো)। আর তোমরা একে অপরকে হত্যা করো না। নিশ্চয়ই আল্লাহ তোমাদের প্রতি অতি দয়াশীল। আর যে কেউ সীমালঙ্ঘন ও নির্যাতন করে এ রকম করবে আমি তাকে জাহান্নামের আগুনে নিক্ষেপ করব। এটা আল্লাহর জন্য খুবই সহজ।’ (সূরা নিসা: ২৯-৩০)

ইসলাম লোকজনকে নিয়ে ঠাট্ট-বিদ্রুপ করতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! কোন পুরুষ যেন অন্য পুরুষকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে। সম্ভবতঃ ওরা বিদ্রুপকারীদের থেকে ভাল হতে পারে। আর কোন নারী যেন অন্য নারীকে নিয়ে ঠাট্টা-বিদ্রুপ না করে। সম্ভবতঃ ওরা বিদ্রুপকারিণীদের থেকে ভাল হতে পারে। তোমরা একজন আরেকজনকে দোষারোপ করো না এবং একজন আরেকজনকে মন্দ নামে ডেকো না। ঈমান আনার পর অসৎ কাজ করা কতই না খারাপ। আর যারা তওবা করে না তারাই অত্যাচারী।’ (সূরা হুজুরাত: ১১)

ইসলাম পরনিন্দা করতে নিষেধ করেছে। আল্লাহ তা‘আলা বলেন, ‘হে ঈমানদারগণ! তোমরা অধিক ধারণা থেকে দূরে থাক। কারণ কোন কোন ধারণা গুনাহ। আর তোমরা অন্যের গোপন বিষয় অন্বেষণ করো না এবং তোমরা একজন আরেকজনের পরনিন্দা করো না। তোমাদের কেউ কি তার মৃত ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করাকে পছন্দ করবে? না, তোমরা একে অপছন্দই করবে। ভয় করো আল্লাহকে, নিশ্চয়ই আল্লাহ তওবা কবুলকারী ও দয়াবান।’ (সূরা হুজুরাত: ১২)

ইসলাম জিহ্বা ও হাত দ্বারা কাউকে কষ্ট দিতে নিষেধ করেছে। আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘প্রকৃত মুসলিম হল সে, যার জিহ্বা ও হাত থেকে অন্য মুসলিম নিরাপদ থাকে।’ [বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৬] রাসূল সা. বলেছেন, ‘যার অসদাচরণ থেকে প্রতিবেশী নির্ভয় ও নিরাপদ থাকতে পারে না, সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না।’ (বুখারী ও মুসলিম, মিশকাত হা/৪৯৬৩)

শুধু মানুষ নয়, বরং কোনো প্রাণীর উপরও জুলুম করা ইসলামে হারাম। আব্দুল্লাহ বিন ওমর রা. বর্র্ণনা করেন আল্লাহর রাসূল সা. বলেছেন, ‘একজন মহিলাকে একটি বিড়ালের কারণে আযাব দেওয়া হয়েছে। সে বিড়ালকে বেঁধে রেখেছে। তাই সে মারা গেছে। ফলে মহিলাটি জাহান্নামে প্রবেশ করেছে। মহিলাটি যখন বিড়ালকে বেঁধে রেখেছিল তখন তাকে খেতেও দেয়নি এবং পান করতেও দেয়নি। এমনকি তাকে মাটির কীট পতঙ্গও খেতে দেয়নি।’ (বুখারি, মুসলিম ও মিশকাত হা/১৯০৩)

বিশ্বশান্তির অগ্রদূত বিশ্বনবী সা. প্রবর্তিত ইসলামকে বিশ্বের সবচেয়ে শান্তির ধর্ম বলে ঘোষণা করেছে জাতিসংঘের শিক্ষা, বিজ্ঞান ও সংস্কৃতি বিষয়ক অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কো। এ সম্পর্কিত একটি বিবৃতি প্রকাশ করে ইউনেস্কো। এর আগে ইউনেস্কো ইন্টারন্যাশনাল পিস ফাউন্ডেশন-এর সঙ্গে যৌথভাবে বিশ্বের সবগুলো ধর্ম নিয়ে গবেষণা চালায়।

ঐ গবেষণার মূল উদ্দেশ্য ছিল বিশ্বের সবচেয়ে শান্তিপূর্ণ ধর্ম কোনটি তা খতিয়ে বের করা। এক সংবাদ সম্মেলনে ইন্টারন্যাশনাল পিস ফাউন্ডেশনের তুলনামূলক গবেষণা বিভাগের প্রধান রবার্ট ম্যাকগি বলেন, ছয় মাসব্যাপী গভীর গবেষণা ও বিশ্লেষণের পর আমরা এই উপসংহারে উপনীত হয়েছি যে, ইসলামই বিশ্বের সবচেয়ে শান্তির ধর্ম। (সূত্র: আলোকিত বাংলাদেশ: ২৫ মার্চ, ২০১৯)

এদিকে বিশ্বের বড় বড় রাজনৈতিক ও ধর্মীয় নেতারা ইউনেস্কোর এই সনদ ও ঘোষণাকে স্বাগত জানিয়েছেন।

তবে, অনেক ইসলামী পন্ডিতের মতে, ইসলাম আগে থেকেই শান্তির ধর্ম এবং বিশ্বসেরা ও সর্বশেষ ধর্ম হিসেবে পরিচিত ছিল। সূতরাং ইউনেস্কোর এই ঘোষণার কোনো দরকার ছিল না। তারপরও আশার কথা হলো, ইউনেস্কো ঘোষণার ফলে যারা ইসলামকে জঙ্গিবাদ, রক্তারক্তি ও সন্ত্রাসের ধর্ম হিসেবে অপপ্রচার চালিয়ে খুশি হন তাদের জিহ্বা সামান্যতম হলেও সংযত হবে। মহানবী হযরত মুহাম্মাদ সা. এর জন্ম ও মৃত্যু’র এ মাসে লাখো কোটি দূরুদ ও সালাম জানাই নবী পাকের দরবারে। শান্তির বার্তাবাহী এই মহামানবের অমিয়বানী ও জীবনদর্শন আমাদের পাথেয় হোক। আমিন।

লেখক : বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা যশোর।
bhmahini@gmail.com

RELATED ARTICLES

Most Popular