মতামতঃ
মৃত ব্যক্তির পরিত্যক্ত সম্পত্তি বন্টন সংক্রান্ত নীতিমালা সচেতন মানুষ হিসেবে সকলের জেনে রাখা জরুরি। উত্তরাধিকার আইন এবং বন্টন নীতিমালা না জানার ফলে সমাজে প্রায়ই বিভেদ-সংঘাত লক্ষ্য করা যায়। বাংলাদেশে মুসলিম পারিবারিক আইনে পুত্রসন্তান কণ্যা অপেক্ষা দ্বিগুণ সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়। অন্যদিকে খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনে এমন কোনো পার্থক্য দেখা যায় না। অর্থাৎ পুত্র ও কন্যা প্রত্যেকেই সমান অংশ পায়। তবে হিন্দু ও বৌদ্ধ আইনে পুত্রের উপস্থিতিতে কন্যা সন্তান কোনো সম্পত্তি পায় না। তবে কোনো হিন্দু পিতা-মাতা চাইলে তাদের সম্পত্তি থেকে জীবিত অবস্থায় কন্যা সন্তানকে সম্পত্তির মালিক বানাতে পারেন।
বাংলাদেশে প্রসিদ্ধ ধর্ম চারটি- মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্টান ও বৌদ্ধ। উল্লিখিত প্রতিটি ধর্মীয় আইনে উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত ভিন্ন ভিন্ন দিকনির্দেশনা রয়েছে। মুসলিম উত্তরাধিকার নীতিতে আমরা দেখতে পাই- একজন পুত্র যে সম্পত্তি পায়, কন্যা তার অর্ধেক পায়। উদাহরণ স্বরূপ, আব্দুর রহমান এক পুত্র তারেক ও এক কন্যা সাদিয়াকে রেখে মারা গেলেন। মৃত আব্দুর রহমানের ৯ বিঘা সম্পত্তি আছে। এ ক্ষেত্রে মুসলিম উত্তরাধিকার আইনানুসারে সাদিয়া পাবে ৩ বিঘা সম্পত্তি। অন্যদিকে তারেক পাবে ৬ বিঘা সম্পত্তি। উক্ত আইনানুযায়ী কন্যা সন্তানরা ৩টি অবস্থায় সম্পত্তি পাবে। ক. মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তান না থাকলে, কন্যা ১ জন থাকলে সে ১/২ অংশ পাবে, অর্থাৎ অর্ধেক সম্পত্তি পাবে। খ. মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তান না থাকলে, কন্যা সন্তান দুই বা ততোধিক থাকলে তারা উভয়ে একসঙ্গে ২/৩ অংশ পাবে, অর্থাৎ তিন ভাগের দুই ভাগ পাবে। গ. মৃত ব্যক্তির পুত্র সন্তান থাকলে, এক বা একাধিক কন্যা থাকলে, কন্যারা (২:১) সমীকরণে পাবে। অর্থাৎ প্রত্যেক কন্যা পুত্রের অর্ধেক পাবে। তবে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনানুযায়ী সাদিয়া কোনো সম্পত্তি পাবে না। বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইনানুযায়ী পুত্র সন্তানের বর্তমানে কন্যা কোনো সম্পত্তি পায় না। হিন্দু আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে আইনে উল্লিখিত নির্দিষ্ট ক্রম বা তালিকা অনুসরণ করতে হয়। কার্যত ক্রমের দিক থেকে যে প্রথম সে ব্যক্তি সমুদয় সম্পত্তি পায়। এদিক থেকে কন্যা ও পুত্র যথাক্রমে ৫ এবং ১ নম্বর ক্রমের অন্তর্ভুক্ত। সুতরাং কন্যা বঞ্চিত হবে।
তবে খ্রিস্টান আইন ও নীতিতে বিষয়টি একেবারে ভিন্ন। এই আইন অনুযায়ী পুত্র ও কন্যা মৃত্যের পরিত্যক্ত সম্পত্তিতে সমান অংশের দাবিদার। অর্থাৎ খ্রিস্ট উত্তরাধিকার আইনানুসারে তারেক ও সাদিয়া ১/২ অংশ করে সম্পত্তি পাবে। অপরদিকে বৌদ্ধ ধর্মে উত্তরাধিকার সম্পর্কে স্পষ্ট কোনো বিধান উল্লেখ না থাকায় বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু দায়ভাগ উত্তরাধিকার-সংক্রান্ত নিয়ম মেনে চলে। অর্থাৎ বৌদ্ধ ধর্মানুসারে সাদিয়া কোনো সম্পত্তি পাবে না। মুসলিম আইনে নারী শুধু পিতা নয়, বরং স্বামী, মাতা, ভাইসহ আরও অনেকের কাছ থেকে সম্পত্তি পেয়ে থাকে।
মুসলিম উত্তরাধিকার নীতিমালায় মৃত ব্যক্তির পিতা-পুত্রের সঙ্গে উপস্থিত থাকলে ১/৬ (ছয় ভাগের এক ভাগ) অংশ সম্পত্তি পায়। অন্যদিকে কন্যার সঙ্গে উপস্থিত থাকলে ১/৬ (ছয় ভাগের এক ভাগ) অংশ এবং অবশিষ্টভোগী হিসেবে বাকি সম্পত্তি পায়। অন্যদিকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে মৃত ব্যক্তির পুত্র থাকলে পিতা সম্পত্তি পায় না। কারণ পুত্র ও পিতার ক্রম যথাক্রমে ১ ও ৭। খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনানুসারে সন্তানের (পুত্র/কন্যা) সঙ্গে পিতা উপস্থিত থাকলে পিতা অবশিষ্ট সম্পত্তির ১/৩ (তিন ভাগের এক ভাগ) অংশ পাবে। বাকি ২/৩ (তিন ভাগের দুই ভাগ) অংশ ক্ষেত্রবিশেষ পুত্র বা কন্যা পাবে। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দু উত্তরাধিকার আইনের অনুরূপ বিধান পালন করবে। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পিতা-পুত্রের উপস্থিতিতে কোনো সম্পত্তি পাবে না।
ইসলাম ধর্মে উত্তরাধিকার নীতিতে ‘মাতা’ মৃতের পুত্র বা কন্যার উপস্থিতিতে ১/৬ (ছয় ভাগের এক ভাগ) অংশ সম্পত্তি পায়। তবে সন্তানরা উপস্থিত না থাকলে ১/৩ (তিন ভাগের এক ভাগ) অংশ পায়। এ ক্ষেত্রে হিন্দু ধর্মানুসারে পুত্র কিংবা কন্যার উপস্থিতিতে মাতা কোনো সম্পত্তি পাবে না। কারণ পুত্র, কন্যা ও মায়ের ক্রমপর্যায়ক্রমে ১, ৫ ও ৮। অন্যদিকে খ্রিস্টান আইনানুযায়ী মাতা সন্তানের উপস্থিতিতে কোনো সম্পত্তি পায় না। মাতা শুধু মৃত ব্যক্তির সন্তান ও পিতার অনুপস্থিতিতে সম্পত্তির অংশীদারি হন। অর্থাৎ মৃতের পিতা বা সন্তান-সন্তুতি বেঁচে থাকলে মা বঞ্চিত হবেন।
বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু, খ্রিস্ট ও বৌদ্ধ উভয় ধর্মে মৃত ব্যক্তির দাদাকে (পিতার পিতা) সম্পত্তির আইনগত উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে যে বিষয়টি গুরুত্ব দিয়েছে সেটি হলো- মৃতের পিতা বা পুত্রের উপস্থিতিতে দাদা বঞ্চিত হবে। মুসলিম আইনে মৃতের কন্যার উপস্থিতিতে দাদা থাকলে দাদা বঞ্চিত হয় না। বরং দাদা এ ক্ষেত্রে ১/৬ (ছয় ভাগের এক ভাগ) অংশ এবং অবশিষ্টভোগী (আসাবা) হিসেবে সম্পত্তি পায়। তবে খ্রিস্টান আইনে মৃত ব্যক্তির পুত্র থাকুক কিংবা কন্যা থাকুক দাদা সম্পত্তি পাবে না। তিনি শুধু তখনই সম্পত্তি পাবেন যখন মৃতের কোনো ধরনের সন্তান থাকবে না। হিন্দু আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ক্রমে দাদার অবস্থান ১৩তম। সুতরাং ওপরের ১২ জনের অনুপস্থিতিতে দাদা উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হবে। কেননা হিন্দু আইনের নীতি হলো, যিনি ক্রমের দিক থেকে প্রথমে তিনি অগ্রাধিকার পাবেন। সে ক্ষেত্রে পুত্র বা কন্যার উপস্থিতিতে দাদা বঞ্চিত হবেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য হিন্দু ধর্মের অনুরূপ বিধান প্রযোজ্য।
ইসলমি উত্তরাধিকার আইনে মৃত্যের স্বামী দুটি অবস্থায় সম্পত্তি পেয়ে থাকে। ক. পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) উপস্থিত না থাকলে স্বামী পাবে ১/২ (অর্ধেক) অংশ। খ. উল্লিখিত কেউ উপস্থিত থাকলে স্বামী পাবে ১/৪ (চার ভাগের এক) অংশ। অন্যদিকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি বণ্টনের ৫৩টি ক্রমের মধ্যে স্বামীর উত্তরাধিকার সম্পর্কে কিছু বলা হয়নি। কারণ স্ত্রী শুধু জীবনস্বত্ব হিসেবে সম্পত্তি পায়। কাজেই তিনি মারা যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে উৎস থেকে সম্পত্তি পেয়েছিলেন সে উৎস বরাবর সম্পত্তি ফিরে যায়। খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনে স্বামী যদি মৃতের সন্তানদের সঙ্গে উপস্থিত থাকে, তাহলে তিনি পরিত্যক্ত সম্পত্তির ১/৩ (তিন ভাগের এক) অংশ পাবেন। বাকি ২/৩ (তিন ভাগের দুই) অংশ সন্তানরা সমান হারে পাবেন। বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীরা হিন্দুদের অনুরূপ বিধান পালন করবে।
ইসলামি পারিবারিক আইনে স্ত্রী দুটি অবস্থায় সম্পত্তি পায়। ক. পুত্র, পুত্রের পুত্র, কন্যা, পুত্রের কন্যা (যতই নিম্নগামী হোক) উপস্থিত না থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৪ (চার ভাগের এক) অংশ। খ. উল্লিখিত কেউ উপস্থিত থাকলে স্ত্রী পাবে ১/৮ অংশ। অন্যদিকে হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে স্ত্রী সম্পত্তি পায় এক পুত্রের সমান সম্পত্তি। যেমন : মৃত ব্যক্তি যদি দুই পুত্র রেখে মারা যায়, তবে ২ পুত্র এবং স্ত্রী ১/৩ (তিন ভাগের এক) অংশ করে সম্পত্তি পাবেন। একইভাবে যদি ৪ পুত্র রেখে মারা যান, তাহলে তারা সবাই ১/৪(চার ভাগের এক) অংশ করে সম্পত্তি পাবেন। অর্থাৎ এখানে স্ত্রীকে ১ পুত্রের সমান অংশ মর্যাদা দেওয়া হয়েছে। এ ছাড়া খ্রিস্টান আইনে সন্তানদের সঙ্গে স্ত্রী থাকলে স্ত্রী ১/৩ (তিন ভাগের এক) অংশ সম্পত্তি পাবে। বাকি ২/৩ অংশ সম্পত্তি সন্তানরা সমান হারে পাবে। বৌদ্ধ উত্তরাধিকার হিন্দু ধর্মের অনুরূপ। কার্যতঃ মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে মৃতের ভাই, বোন, চাচা অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পায়।
ইসলামে অংশীদারদের অংশ দেওয়ার পর যদি সম্পত্তি থাকে, তাহলে অবিশিষ্ট অংশের উত্তরাধিকারী হয় ভাই, বোন ও চাচা। সুতরাং আমরা বলতে পারি, মৃতের সন্তানদের উপস্থিতিতে ভাই, বোন, চাচা ক্ষেত্রবিশেষ বঞ্চিত হবে। তবে ইসলাম ধর্মে মৃত ব্যক্তি কন্যা রেখে মারা গেলে ক্ষেত্রবিশেষ ভাই বা বোনরা সম্পত্তি পায়। তবে এ ক্ষেত্রে মৃত ব্যক্তি যদি পুত্র রেখে মারা যান, তাহলে সেটার সুযোগ নেই। অর্থাৎ মৃত ব্যক্তির পুত্রের উপস্থিতিতে মৃতের সব প্রকার ভাই, বোন, চাচা বঞ্চিত হবে। খ্রিস্টান আইনেও মৃতের সন্তানদের (ছেলে/মেয়ে) অনুপস্থিতিতে ভাই, বোনদের অংশীদার হিসেবে বিবেচনা করা হয়েছে। তবে খ্রিস্টান আইন অনুসারে মৃতের সন্তানদের অনুপস্থিতিতে যদি মৃতের মায়ের সঙ্গে ভাই, বোন উপস্থিত থাকে, তাহলে ভাই-বোন ১/২ (অর্ধেক) অংশ এবং মা পাবেন ১/২ (অর্ধেক) অংশ। এ ছাড়া মৃত ব্যক্তির ভাই-বোনদের সঙ্গে স্বামী বা স্ত্রী থাকলে স্বামী বা স্ত্রী সম্পত্তির ২/৩ (তিন ভাগের দুই) অংশ পাবে এবং অন্যরা বাকি ১/৩ (তিন ভাগের এক) অংশ সম্পত্তি সমান হারে পাবেন। কার্যত মৃত ব্যক্তির কোনো পুত্র, পুত্রের পুত্র, পুত্রের পুত্রের পুত্র এবং পিতা জীবিত না থাকলে মৃতের ভাই বা বোনরা উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। উল্লেখ্য, খ্রিস্টান আইনে নারী বা পুরুষের অবস্থা একই। অর্থাৎ এখানে একজন পুরুষ যতটুকু সম্পত্তি পায় ক্ষেত্রমতে একজন নারীও ততটুকু সম্পত্তি পায়। মুসলিম উত্তরাধিকার আইনে কয়েকটি ক্ষেত্র ব্যতীত সৎভাই ও সৎবোনরা সম্পত্তি পায় না। তবে খ্রিস্টান আইনে সৎভাই আপন ভাইদের মতোই উত্তরাধিকারী হয়। অর্থাৎ তারা সম্পত্তিতে সমান অংশ লাভ করেন। হিন্দু আইনে এরূপ কোনো বিধান আলোচিত হয়নি।
বাংলাদেশে মুসলিম, হিন্দু ও খ্রিস্ট উত্তরাধিকার আইনে প্রতিনিধিত্ব নীতিকে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। এ নীতি অনুযায়ী কোনো মৃত ব্যক্তির পুত্র ও কন্যার সঙ্গে যদি অন্য মৃত সন্তানের কোনো পুত্র বা কন্যা থাকে, তাহলে তারা তাদের মৃত পিতা বা মায়ের স্থলাভিষিক্ত হবে। অর্থাৎ মৃত সন্তানের পুত্র-কন্যারা সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে তারা তাদের পূর্বে মৃত পিতা বা মায়ের অংশ পাবে। এ পদ্ধতিকে Doctrine of Representation বা প্রতিনিধিত্ব নীতি বলা হয়। যেমন : নাছিরের নাদিম ও ফরিদ নামে দুই পুত্র আছে। ফরিদ এক কন্যা ফাতিমাকে রেখে তার পিতার (নাছির) পূর্বেই মারা গেলেন। কিছুদিন পর নাছির ৬ বিঘা জমি রেখে মারা যায়। প্রতিনিধিত্ব নীতি অনুযায়ী ফাতিমা তার পিতার অংশ পাবে। অর্থাৎ নাদিম ও সাইমা ৩ বিঘা করে সম্পত্তি পাবে। কিন্তু, হিন্দু আইনে প্রতিনিধিত্ব নীতি কন্যাদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। কেননা, কন্যারা শুধু জীবনস্বত্বের অধিকারিণী। অন্যদিকে পুত্ররা সম্পত্তি পায় স্বয়ংসম্পূর্ণভাবে, জীবন স্বত্ব হিসেবে নয়। যেমন, লক্ষণের ২ কন্যা- মালতি ও পিয়াসী। লক্ষণের ৯ বিঘা জমি আছে। মালতি তার ২ ছেলে গনেশ ও রাকেশ এবং পিয়াসী ১ ছেলে কৃষ্ণকে রেখে মারা গেলেন। এখানে প্রতিনিধিত্ব নীতি অনুযায়ী কৃষ্ণ অর্ধেক এবং বাকি অর্ধেক গনেশ ও রাকেশের পাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এটি হবে না। কারণ লক্ষণের কন্যারা জীবন স্বত্বের অধিকারিণী বিধায় দৌহিত্ররা সরাসরি লক্ষণের উত্তরাধিকারী হবে। অর্থাৎ তারা প্রত্যেকে ১/৩ অংশ করে তথা ৩ বিঘা করে সম্পত্তি পাবে- (সূত্র : হিন্দু আইন বই, শ্রী দীনেশচন্দ্র দেবনাথ)।
হিন্দু ধর্মে দত্তকের বিধান লক্ষণীয়। দত্তক পুত্র সাধারণ পুত্রের ন্যায় সম্পত্তি পায়। তবে দত্তক পুত্র গ্রহণ করার পর যদি স্বাভাবিক পুত্র জন্মগ্রহণ করে তাহলে দত্তক পুত্র সমুদয় সম্পত্তির ১/৩ (তিন ভাগের এক) অংশ পাবে। অন্যদিকে স্বাভাবিক পুত্র বাকী ২/৩ (তিন ভাগের দুই) অংশ পাবে। মুসলিম ও খ্রিস্টান আইনে দত্তকের কার্যকারিতা নেই। হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে অসতীত্ব, জাতিচ্যুত, ধর্মান্তরিত, কুষ্ঠরোগী, দৈহিক বা মানসিক ত্রুটি (অন্ধ, বোবা, জন্মগত প্রতিবন্ধী, পুরুষত্বহীন ইত্যাদি) সম্পন্ন ব্যক্তিরা উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়। মুসলিম ও খ্রিস্টান আইনে এরূপ কোনো বিধান নেই। তবে ইসলাম ধর্মে উত্তরাধিকার থেকে বঞ্চিত হয়- হত্যাকারী, স্বধর্মত্যাগী, রাষ্ট্রদ্রোহী, নিখোঁজ ব্যক্তি। খ্রিস্ট ও ইসলাম ধর্মে জ্ঞাতি শ্রেণির আত্মীয়দের গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। ইসলাম ধর্মে জ্ঞাতি শ্রেণির আত্মীয়রা নিকটবর্তী আত্মীয়দের অনুপস্থিতিতে অবশিষ্টভোগী হিসেবে সম্পত্তি পাবে।
অপরদিকে খ্রিস্টান আইন অনুযায়ী মৃতের সন্তান, পিতা, মাতা, ভাই, বোনের অবর্তমানে যদি জ্ঞাতি সম্পর্কীয় আত্মীয়রা উপস্থিত থাকে, তাহলে স্ত্রী মোট সম্পত্তির ১/২ (অর্ধেক) অংশ পাবে। অন্যদিকে অবশিষ্ট ১/২ (অর্ধেক) অংশ সম্পত্তি জ্ঞাতি আত্মীয়রা সমানভাবে পাবে। জ্ঞাতি সদস্যদের মধ্যে রয়েছে চাচা, চাচি, চাচার ছেলে ও মেয়ে, খালা, খালাতো ভাই, মামাতো ভাই, ফুফু এবং এই ধারাবাহিকতায় অন্যরা। মুসলিম ও খ্রিস্টান উত্তরাধিকার আইনে পুত্রের কন্যারা ক্ষেত্রবিশেষ সম্পত্তির উত্তরাধিকারী হিসেবে বিবেচিত হয়। কিন্তু হিন্দু উত্তরাধিকার আইনে সম্পত্তি পাওয়ার ক্ষেত্রে কন্যার পুত্রদের অবস্থা বর্ণনা করা হলেও পুত্রের কন্যাদের অবস্থা বর্ণনা করা হয়নি।
উত্তরাধিকার আইন বিশেষজ্ঞ ও নারীবাদী সংগঠনগুলোর মতে, বাংলাদেশে প্রচলিত হিন্দু উত্তরাধিকার আইন সংস্কার প্রয়োজন। পৃথিবীর হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশ ভারত ১৯৫৬ সালে আইন প্রণয়ন করে পূর্বের অনেক বিধিবিধান পরিবর্তন করেছে। বাস্তবতার সঙ্গে সংগতি রেখে উত্তরাধিকার আইনে নারীর অধিকার স্বীকৃতিতে তারা যথেষ্ঠ অবদান রেখেছে। অন্যদিকে প্রতিবেশী দেশ হওয়ার সত্ত্বেও বাংলাদেশে এমন কোনো বিধান আজও গ্রহণযোগ্যতা পায়নি। বাংলাদেশের বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য একটি পৃথক উত্তরাধিকার আইন থাকার দাবি মোটেও অযৌক্তিক নয়। বরং বহুল প্রচলিত স্বতন্ত্র ধর্ম হিসেবে বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বীদের জন্য পৃথক উত্তরাধিকার আইন প্রণয়ন এখন সময়ের দাবি।
সর্বোপরি প্রচলিত ৪টি ধর্মে উত্তরাধিকার সংশ্লিষ্ট বিধান একটি অন্যটি অপেক্ষা ভিন্ন। খ্রিস্টধর্মে পুত্র, কন্যা, আপন ভাই এবং সৎ ভাইয়ের মধ্যে সম্পত্তি বণ্টনের ক্ষেত্রে কোনো পার্থক্য করা হয়নি। অন্যদিকে ইসলাম ধর্মে পুত্র, কন্যা সন্তানের দ্বিগুণ সম্পত্তি পায়। অর্থাৎ কন্যা পুত্রের অর্ধেক অংশ পায়। বাহ্যিকভাবে মনে হয়, ইসলাম কন্যাসন্তানের প্রতি বৈষম্য করেছে। তবে এমনটি মনে হলেও, ইসলাম বৈষম্য করেছে এ কথাটি মোটেও যুক্তিযুক্ত নয়। বরং অন্তর্নিহিত দৃষ্টিকোণ থেকে ইসলাম নারীকে পুরুষের সমমর্যাদায় অংশীদারি করেছে। কেননা, নারীরা পিতা, পুত্র, ভাই, স্বামী ও পিতা-মাতার কাছ থেকে সম্পত্তি প্রাপ্ত হয়। এমনকি প্রচলিত আইনে দাদার সম্পত্তির অংশও পৌত্রী (পুত্রের কন্যা) লাভ করে। সম্পত্তি বন্টন নীতিমালা তথা ইলমুল ফারায়েজ সম্পর্কে সাম্যক জ্ঞান থাকলে উত্তরাধিকার সম্পত্তি বন্টন সক্রান্ত সামাজিক সংঘাত ও হানাহানি থেকে মুক্তি পাওয়া সহজ হবে।
বিলাল মাহিনী
গবেষক : আল ফিকহ ওয়াল ফারায়েজ (মুসলিম আইন ও উত্তরাধিকার বিভাগ)
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
bhmahini@gmail.com