আমির হোসেন আমু। রাজনীতির কিংবদন্তী। মুক্তিযুদ্ধের সংগঠক। পঁচাত্তরত্তোর আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে হয়ে উঠেছিলেন ‘কিং মেকার’। উনসত্তুরের গণ-অভ্যুত্থানের মহানায়ক তোফায়েল আহমেদের ভাষায় আমির হোসেন আমু আপাদমস্তক এক রাজনীতিবিদ।
বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনার সর্বাপেক্ষা বিশ্বস্ত সহচর হিসেবে দলের অভ্যন্তরে নিরঙ্কুশ প্রাধান্য বিস্তারকারী এ নেতার ইস্কাটনের ৪২ নম্বর বাড়িটিও হয়ে উঠতো একটি উপদলীয় কার্যালয়। তিনি ছিলেন নেতা বানানোর কারিগর। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে শুধু নয়, শেখ হাসিনা ছাত্রলীগের নেতৃত্ব নির্বাচনেও আমির হোসেন আমুর পছন্দকেই অধিকতর গুরুত্ব দিতেন।
সত্যিকার অর্থে তিনি যতটা না ‘কর্মীবান্ধব’ নেতা তার অধিক ‘নেতাবান্ধব’। তাকে বাইরের রূপে রুক্ষ ও অহংবাদী মনে হলেও ভেতরটা দারুণ আন্তরিকতায় পরিপূর্ণ। দলীয় নীতিনির্ধারণে যখন কর্তৃত্ববাদী প্রবীণ নেতারা শেখ হাসিনার নেতৃত্বকে প্রশ্নবিদ্ধ করতেন কিংবা নিজেদের কর্তৃত্ব জাহির করতে চাইতেন তখন আমির হোসেন আমু রাজনীতির অন্দরমহলে লড়েছেন ব্যাঘ্রের মতন।
বহুল আলোচিত ওয়ান ইলেভেনের খড়গ অনেকটা তার মাথার ওপরও পড়ে আমু-রাজ্জাক, তোফায়েল-সুরঞ্জিত ও জলিল”- এ পাঁচ বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদের জন্য রচিত হয় এক ট্রাজেডি। পাঁচ নেতাকেই ছিঁটকে পড়তে হয় প্রেসিডিয়াম থেকে। অবস্থান হয় উপদেষ্টা পরিষদে। ২০০৯ সালে গঠিত মন্ত্রিসভা থেকেও রাখা হয় বাইরে।
২০১৩ নির্বাচনকালীন মন্ত্রিসভায় স্থান পেয়ে আবারও প্রভাবশালী হয়ে ওঠেন আমির হোসেন আমু ও তোফায়েল আহমেদ। আওয়ামী লীগ নির্বাচনী বিজয়ের পর সরকার গঠন করলে আমির হোসেন আমু শিল্পমন্ত্রী ও তোফায়েল আহমেদ বাণিজ্যমন্ত্রী হন। অবশ্য সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও মন্ত্রিসভায় ঠাঁই পাননি তারা।
আমুর উত্থান যেভাবে আওয়ামী লীগের দোর্দণ্ডপ্রতাপশালী নেতা ছিলেন আমির হোসেন আমু। একই সঙ্গে আওয়ামী লীগের একাধিক জেলা ও কেন্দ্রীয় নেতৃত্বে অধিষ্ঠিত ছিলেন। অর্থাৎ বরিশাল ও ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি থাকাকালীন কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান পদে আসীন ছিলেন। আওয়ামী যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতাও তিনি।
১৯৫৮-১৯৬১ বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের আহবায়ক এবং ১৯৬২-১৯৬৪ পর্যন্ত বরিশাল জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি থাকাকালীনই পূর্ব পাকিস্তান ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৬৩ ও ১৯৬৪ সালে পরপর দু’বার বরিশাল বিএম কলেজ ছাত্র সংসদের ভিপি নির্বাচিত হওয়া আমু কেন্দ্রীয় ছাত্রলীগের রাজনীতিতে উঠে আসেন। ১৯৬৫ সালে ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক ও ১৯৬৭ সালে কেন্দ্রীয় কোষাধ্যক্ষ নির্বাচিত হন।
আমু ১৯৭০ সালের নির্বাচনে বরিশাল কোতোয়ালি আসনে প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম এ সংগঠক ১৯৭৩ সালে প্রথম জাতীয় সংসদের নির্বাচনে বরিশাল কোতোয়ালির আসনের স্থলে ঝালকাঠি-রাজাপুর আসনে থেকে নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে ঝালকাঠি জেলার গর্ভনর ও ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির দায়িত্বগ্রহণ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর আমির হোসেন আমুকেও গ্রেফতার করা হয়।
তিনি ১৯৭৮ সাল পর্যন্ত কারাগারে কাটান। কারামুক্ত হয়েই আওয়ামী যুবলীগের চেয়ারম্যান এবং আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক নির্বাচিত হন। ১৯৮০ সালে বরিশাল জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি তখন তিনি ঝালকাঠি জেলা আওয়ামী লীগেরও সভাপতি। পাশাপাশি আওয়ামী লীগের যুব সম্পাদক ও যুবলীগের চেয়ারম্যান তো ছিলেনই। ১৯৮১ সালে হন আওয়ামী লীগের কাউন্সিলে যুগ্ম সম্পাদক। ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত আমু যুবলীগেরও চেয়ারম্যান ছিলেন।
যুবলীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা আমির হোসেন আমু যুবলীগকে সারাদেশে একটি শক্তিশালী সংগঠনে পরিণত করেন। সত্যিকার অর্থেই সহযোদ্ধাদের জন্য প্রকৃত সৃষ্ট নেতা তিনি। স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনের রূপকার বলা হয় তাকে। তিনি ১৯৮১ থেকে ১৯৯২ সাল পর্যন্ত যুগ্ম সম্পাদক এবং এরপর ২০০৯ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য পদে অধিষ্ঠিত ছিলেন। ১৯৯৯ সালে আওয়ামী লীগের ৫০ বছর – সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন কমিটির চেয়ারম্যান হিসেবে যখন দায়িত্বপালন করেন। তখন শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়।
১৯৯৬-২০০১ মেয়াদে ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগের ভারপ্রাপ্ত সভাপতির দায়িত্বপালন করেন আমির হোসেন আমু। তিনি ১৯৯৯ সালের ২৮ ডিসেম্বর খাদ্যমন্ত্রী হিসেবে শপথ গ্রহণ করেন। পরবর্তীতে ঝালকাঠি-২ আসনের উপনির্বাচনে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। স্বাধীনতার রজতজয়ন্তী উদযাপন কমিটিরও চেয়ারম্যানের পদ অলংকৃত করে এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাসে স্থান করেন আমির হোসেন আমু।
তিনি আওয়ামী লীগ সংসদীয় বোর্ডের অন্যতম সদস্য। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর নির্বাচনে ঝালকাঠি-২ আসন থেকে বিজয়ী হওয়া আমুকে ২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর নির্বাচনকালীন সরকারের ভূমি ও ত্রাণমন্ত্রী করা হয়। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি ফের সংসদ সদস্য হওয়ার পর ১২ জানুয়ারি শিল্পমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সর্বশেষ নির্বাচনে বিজয়ী হলেও অবস্থান পাননি মন্ত্রিসভায়। ১৪ দলের সমন্বয়ক ও মুখপাত্র আমির হোসেন আমুকে আগামী নির্বাচনের আগে মন্ত্রিসভা সম্প্রসারণ হলে দেখা যেতে পারে বলে মনে করেন রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা।
উল্লেখ্য, আমির হোসেন আমু ১৯৩৯ সালের ১৫ নভেম্বর ঝালকাঠির শেখের হাটে জন্ম গ্রহণ করেন। তিনি কিশোর বয়সে বাবা মোয়াজ্জেম হোসেন ও মাতা আকলিমা খাতুনকে হারান। নিঃসন্তান আমির হোসেন আমু স্ত্রী শেখ ফিরোজা হোসেনকে হারিয়ে অনেকটাই নিঃসঙ্গ হয়ে পড়েন।
লেখক: সোহেল সানি
সিনিয়র সাংবাদিক, কলামিস্ট ও ইতিহাস বিশেষজ্ঞ।