রাশেদুল হক রিয়াদ (সম্পাদক নবদূত নিউজ)
আজ ১৪ ডিসেম্বর, শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস। ১৯৭১ সালের আজকের এই দিনে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী যখন বুঝতে পারল যে তাদের পরাজয় অনিবার্য, তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার উদ্দেশ্যে, বাঙালি জাতির বরেন্য ও বুদ্ধিজীবীদের তালিকা তৈরি করে, প্রতিহিংসার বশবর্তী হয়ে বেছে বেছে পরিকল্পিতভাবে হত্যা করে এই জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদেরকে। পাকহানাদার বাহিনী ও তাদের দোসরা চেয়েছিল এই জাতিকে বুদ্ধিবৃত্তিকভাবে নিঃস্ব করে দেবার জন্য।
আজকের এই দিনে আমরা গভীর শোক ও শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করছি জাতির সেই শ্রেষ্ঠ সন্তানদের, যাঁদের আমরা হারিয়েছি স্বাধীনতা সংগ্রামের সূচনা থেকে শুরু করে চূড়ান্ত বিজয়ের ঠিক আগমুহূর্ত পর্যন্ত— বুদ্ধীজীবীদের নাম সরণ করতে গেলে প্রথমেই যে নামগুলো আসে তারমধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু নাম হলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক ড. মুনীর চৌধুরী, আনোয়ার পাশা, দর্শনশাস্ত্রের গোবিন্দচন্দ্র দেব, মোফাজ্জল হায়দার চৌধুরী, ড. জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, আবদুল মুকতাদির, এস এম রাশিদুল হাসান, ড. এন এম ফয়জুল মাহী, ফজলুল রহমান খান, এ এন এম মুনিরুজ্জামান, ড. সিরাজুল হক খান, ড. শাহাদাত আলী, ড. এম এ খায়ের, এ আর খান নাদিম, সাদেক, শরাফত আলী, গিয়াস উদ্দীন আহমদ, অনুদ্বৈপায়ন ভট্টাচার্য।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. হবিবুর রহমান, ড.শ্রী সুখরঞ্জন সমাদ্দার, মীর আবদুল কাইয়ুম, চিকিৎসক ডা. শামসুদ্দীন আহমেদ, ডা. হুমায়ুন কবীর, ডা. মুনসী আলী, ডা. নুরুল ইমাম, সাংবাদিক শহীদুল্লাহ কায়সার, সেলিনা পারভীন, আ ন ম গোলাম মস্তফা, গীতকার ও সুরকার আলতাফ মাহমুদ, রাজনীতিবিদ ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত, লেখক ও চলচিত্রকার জহির রায়হান, কবি মেহেরুন্নেসা, শিক্ষাবিদ ড. আবুল কালাম আজাদ। একই সঙ্গে সহমর্মিতা ও কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি প্রত্যেক শহীদ বুদ্ধিজীবী পরিবারের স্বজনদের প্রতি, যাঁরা দীর্ঘ ৫০ বছর ধরে বয়ে চলেছেন আপনজনকে হারানোর বেদনা ও কষ্ট।
বুদ্ধিজীবী নিধনের এই পরিকল্পিত ঘটনার সঙ্গে এ দেশেরই কিছু মানুষ সক্রিয় ভূমিকা পালন করেন। পাকিস্তানি বাহিনীর সহযোগী শক্তি রাজাকার, আলবদর ও আলশামস বাহিনীর সদস্যদের সক্রিয় সহযোগিতার কারণেই এতটা ব্যাপক ও পরিকল্পিত হত্যাযজ্ঞ চালানো সম্ভব হয়েছিল। বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া এই বাহিনীগুলোর সদস্যরাই বাড়ি বাড়ি গিয়ে বুদ্ধিজীবীদের উঠিয়ে এনেছেন; তুলে দিয়েছেন পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে, কোনো কোনো ক্ষেত্রে নিজেরাই হত্যাযজ্ঞ সম্পন্ন করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধিজীবীদের অবদান ছিল অসামান্য। তাদের হাত ধরেই মহান মুক্তিযুদ্ধ প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পরিচালিত হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের অসংখ্য লেখক, সাংবাদিক, শিল্পী, চিকৎসক, শিক্ষক তাদের অক্লান্ত পরিশ্রমের মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধকে অগ্রগামী করেছেন।
মুক্তিযুদ্ধের মূল নিয়ামক শক্তি ছিল জনগণ, তথাপি যুদ্ধের মানুষকে উদ্বুদ্ধ করার ক্ষেত্রে বুদ্ধীজীবীদের অবদান ছিল খুবই প্রশংসনীয়। পত্র-পত্রিকায় লেখালেখি, স্বাধীন বাংলা বেতারকেন্দ্রে খবর পাঠ, দেশাত্মবোধক গান, মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক গান, কবিতা পাঠ, নাটক, কথিত ও অত্যাতন্ত জনপ্রিয় অনুষ্ঠানগুলো বুদ্ধীজীবীরাই পরিচালনা করেন।
বুদ্ধীজীবীরা, রণক্ষেত্রে মুক্তিযোদ্ধাদের মানসিক, নৈতিক বল ধরে রাখতে সহায়তা, সাহস জোগানোর ক্ষেত্রে এবং জনগণকে শত্রুর বিরুদ্ধে দুর্দমনীয় করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। যা বিশ্বদরবারে প্রশংসা কুড়িয়েছে। এক কথায় যদি বলা হয় মুক্তিযুদ্ধের দিক নির্দেশক কারা ছিল তবে বুদ্ধীজীবী হবে সেটার উত্তর। অন্যদিকে স্বাধীনতা আন্দোলনে রাজনৈতিক ব্যক্তবর্গের অবদান অতুলনীয়।
রাজনৈতিক ব্যক্তিবর্গ দলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করে। মহান মুক্তিযুদ্ধে বুদ্ধীজীবী ও অন্যান্য বাঙালিদের অক্লান্ত পরিশ্রম ও জীবনের বিনিময়ে বাঙালি বিজয়ের দারপ্রান্তে এসে যখন উপস্থিত তখন পাকিস্তানের গভর্নরের সামরিক উপদেষ্টা মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলী এক সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা গ্রহণ করেন। তিনি এদেশের শ্রেষ্ঠ মানুষদের নিঃশ্বেষ করে বাঙালি জাতিকে মেধাশূণ্য করার এক নীলনকশা আঁকেন। সেই নকশানুযায়ী পাকিস্তানী বাহিনীর সহযোগিতায় রাজাকার, আলবদর, আলশামস বাহিনী দেশের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের ধরে নির্মমভাবে হত্যা করে।
প্রতিবছর বুদ্ধীজীবী দিবস পালন বাঙালির মনে একটি নতুন প্রশ্ন রেখে যায়। বুদ্ধীজীবীরা যেমন তাদের জীবন দিয়ে প্রমাণ করে গিয়েছেন দেশের জন্য, দেশের মানুষের জন্য, সর্বপরি দেশের কল্যাণের জন্য তারা যেমন অকাতরে নিজের জীবন দিতে দ্বীধাবোধ করেননি, বীর সৈনিক হিসেবে কাজ করে গিয়েছেন, ঠিক তেমনি যেন আমরা দেশমাতৃকার প্রয়োজনে তাদের মতো করে তৈরি হই। আর এটাই হলো বুদ্ধীজীবী দিবসের প্রধান শিক্ষা।