বিলাল মাহিনী, যশোর :
পদ্মা বহুমূখী সেতু চালু হলে ফুলের রাজধানী যশোরের গদখালীর ফুল ও যশোর-খুলনা-ঝিনাইদহ অঞ্চলের সবজি দ্রুতই পৌঁছে যাবে রাজধানী ঢাকাসহ দেশের বড় বড় শহরগুলোতে। ফেরিঘাটের জটে পড়ে নষ্ট হবে না কোনও ফুল ও সবজি। দামও বেশ ভালো পাওয়া যাবে। এতে চাষিরা উপকৃত হবে। তাই এ অঞ্চলের কৃষকরা অপেক্ষায় সেতু উদ্বোধনের। দক্ষিণাঞ্চলের ২১ জেলার মানুষের স্বপ্ন পদ্মা সেতু ঘিরে এভাবেই উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে কথাগুলো বলছিলেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার কৃষক সুখেন বিশ্বাস।
কৃষক ও কৃষি বিভাগের সাথে কথা বলে জানা যায়, দেশের চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ ফুল যশোর থেকে সরবরাহ হয়। এই অঞ্চলের প্রায় ১৫শ’ হেক্টর জমিতে ছয় হাজারের মতো চাষি ফুল চাষ করেন।
প্রায় সারাবছরই এখান থেকে কমবেশি ফুল পাঠানো হয় ঢাকাসহ সারা দেশে। বিশেষ দিন ও উৎসবকে ঘিরে ফুল বেচাকেনার রেকর্ডও হয়। পদ্মা সেতু চালু হলে চার থেকে পাঁচ ঘণ্টায় ফুল পৌঁছে যাবে ঢাকায়। এতে ফেরিঘাটে আটকে থেকে ফুল নষ্ট হওয়ার আর কোনও ভয় থাকবে না। আবার ফেরিঘাটের অজুহাতে পাইকারদের কম দাম দেওয়ারও দিন ফুরাবে।
বাংলাদেশ ফ্লাওয়ার সোসাইটির সভাপতি আব্দুর রহিম বলেন, সেতু চালু হলে ঘাটের বিড়ম্বনা আর থাকবে না। এতে ঢাকা ও চট্টগ্রামে দ্রুত সময়ের মধ্যে আমরা ফুল পাঠাতে পারবো। সাধারণত আমরা এখন সবজির ট্রাকে ও যাত্রীবাহী বাসে বান্ডিল করে ফুল পাঠাই। সেক্ষেত্রে বান্ডিল প্রতি এখন খরচ তিনশ’ টাকা। সেতু চালু হলে খরচ হয়তো কিছুটা বাড়তে পারে। সেক্ষেত্রে ফুলের দাম ‘কস্ট অ্যনালাইসিসের’ মাধ্যমে নির্ধারণ করা হবে। তবে শেষ পর্যন্ত চাষিরা লাভবান হবে বলে মনে করেন তিনি।
গদখালীর ফুলের ন্যায় পদ্মা সেতু চালু হলে যশোর থেকে উৎপাদিত শাক-সবজিও দ্রুততম সময়ে রাজধানীতে চলে আসবে। ঘাটে আটকে থেকে আর নষ্ট হওয়ার ভয় থাকবে না। এতে চাষিরাও ভালো দাম পাবেন বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
যশোরের ঐতিহ্যবাহী সবজি হাট বার বাজারের সবজি ব্যবসায়ীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চার ঘণ্টার মধ্যে আমরা ঢাকার যাত্রাবাড়িতে সবজি পৌঁছে দিতে পারবো। এরফলে আমাদের যেমন সময় বাঁচবে, তেমনি সবজি বিনষ্ট হওয়ার শঙ্কা থেকে মুক্ত হবো। তবে কমদামে রাজধানীবাসীদের সবজি খাওয়াতে সেতুর টোলের রেট কমানোর দাবি ব্যবসায়ীদের।
স্থানীয় চাষিরা জানান, যশোরে রবি, খরিপ-১ ও খরিপ-২ এই তিন মৌসুমে যথাক্রমে ১৬ হাজার, ১৪ থেকে ১৫ হাজার এবং ৬ থেকে ৮ হাজার হেক্টর জমিতে সবজি চাষ হয়। এ ধারাবাহিকতায় প্রায় সাড়ে ৮ লাখ মেট্রিকটন সবজি উৎপাদন হয়। যশোরের চাহিদা প্রায় সাড়ে ৬ লাখ মেট্রিকটন। উদ্বৃত্ত অংশ ঢাকাসহ অন্যান্য জেলায় সরবরাহ করা সম্ভব হবে।
এদিকে সেতু চালু হলে ঢাকায় গিয়ে দিনের কাজ দিনে শেষ করে বাড়ি ফেরা যাবে বলে মনে করেন যশোরের অভয়নগর উপজেলার বাসিন্দা তমাল তরু বিশ্বাস। তিনি বলেন, পদ্মা সেতু উদ্বোধন হলে ভোরে রওনা হয়ে সকালেই ঢাকা পৌঁছুতে পারবো। দিনের কাজ শেষে আবার ফিরে আসাও সম্ভব হবে। এই সেতুর ফলে আমাদের ঢাকার দূরত্ব বেশ কমবে। ঘাটের কোনও ঝামেলা পোহাতে হবে না।
কেবল তমাল সাহেবই নন, যশোরের অধিকাংশ মানুষেরই এমন ভাবনা। দীর্ঘসময় ধরে ফেরির জন্যে অপেক্ষার দিন শেষ হচ্ছে তাদের ২৫ জুন।
অভয়নগর উপজেলার নওয়াপাড়া সবজির হাটে খোঁজ নিয়ে জানা যায়, যশোর থেকে ঢাকা যেতে সড়কপথে সময় লাগে ৮ থেকে ১০ ঘণ্টা। কখনও দীর্ঘজটে ঘাটেই বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা। সেতু চালু হলে এমন অবস্থা শেষ হবে। সময়মতো পৌঁছে যাবে মাছ, সবজি, ফুলসহ বিভিন্ন কাঁচামাল।
এদিকে রেণু উৎপাদনের জন্য যশোরের চাঁচড়া এলাকা বেশ পরিচিত। প্রতি সপ্তাহে ১০ প্রজাতির চার থেকে পাঁচ হাজার কেজি রেণু এখানে উৎপাদন হয়। স্থানীয় মৎস্যচাষিদের দবি, দেশে রেণুর মোট চাহিদার অর্ধেকই সরবরাহ করা হয় এই অঞ্চল থেকে। এখানকার চাষিরা আশা করছেন, সেতু চালু হলে প্রতিদিন প্রায় ৩০ লাখ টাকার রেণু বিক্রি করা যাবে। এতে করে ব্যবসার পরিধি বাড়বে, লাভবান হবেন মৎস্যচাষি, ব্যবসায়ী ও শ্রমিকরা।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ পরিবহন সংস্থা শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি আজিজুল আলম মিন্টু বলেন, পদ্মা সেতুর ফলে মানুষের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নতি হবে। ফেরিতে বাসপ্রতি ১৮শ’ টাকা ছিল; সেতুতে ধরা হচ্ছে ২৪শ’ টাকা। এই খরচটা বাড়লেও রাস্তার দূরত্ব কমবে, ভালো রাস্তা হলে রক্ষণাবেক্ষণ ব্যয়ও কমবে। আবার দ্রুত সময়ে গন্তব্যে পৌঁছানো যাবে বলে ট্রিপও বেশি হবে। এতে আয় বাড়বে।
যশোর জেলা ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, ট্যাংকলরি (দাহ্য বাদে) শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক (ভারপ্রাপ্ত) লুৎফর রহমান বলেন, ফেরিপথে না সেতুপথে যেতে হবে- আমাদের এখনও কোনও সিদ্ধান্ত হয়নি। তবে পদ্মা সেতু দিয়ে পার হলে রাস্তা, সময়, তেল খরচ এবং ঘাটে বসে থাকতে যে খরচ- তা আর হবে না। তবে, টোল অস্বাভাবিক হারে বাড়ানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে যারা মাল পরিবহন করবেন, তাদের ইচ্ছাটাকে আমরা প্রাধান্য দেবো।
পদ্মা সেতুর অর্থনৈতিক প্রভাব বিষয়ে যশোর চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সাবেক সভাপতি মিজানুর রহমান খান বলেন, পদ্মা সেতু আমাদের অঞ্চলের অর্থনীতির নতুন দরজা খুলে দেবে। যোগাযোগ ব্যবস্থা সহজ হওয়ায় এখানে ইপিজেড বা অর্থেনৈতিক অঞ্চল গড়ার যে ঘোষণা, তারও দ্রুত বাস্তবায়ন হবে। নতুন নতুন কলকারখানা গড়ে উঠবে; শিল্পের প্রসার ঘটবে। ফলে আমাদের এই অঞ্চলে একটি ব্যাপক অংশের মানুষের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হবে।
আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা শহিদুল ইসলাম মিলন বলেছেন, শত চক্রান্ত মোকাবিলা করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দেশীয় অর্থায়নে নির্মাণ করেছেন স্বপ্নের পদ্মা সেতু। এই সেতুর ফলে যশোরসহ দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলের মানুষের নতুন দিগন্তের সূচনা হবে। স্থানীয়দের জীবনযাত্রার মান আরও উন্নত হবে বলে আশা প্রকাশ করেন তিনি।