বিলাল হোসেন মাহিনী
হিংসা, লোভ ও অহংকার মানুষের সামাজিক রোগ। হিংসুক কখনো সুখী হয় না। লোভী ও অহংকারী মানুষের পতন হয়। কেননা, তাদের কোনো আমল বাকি থাকে না। হজরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত প্রিয়নবী সা. বলেছেন, ‘তোমরা হিংসা থেকে বেঁচে থাক। কেননা হিংসা নেকিকে এমনভাবে খেয়ে ফেলে, যেভাবে আগুন কাঠকে খেয়ে ফেলে অর্থাৎ জ্বালিয়ে দেয়।’ (আবু দাউদ : ৪৯০৩) হিংসা-বিদ্বেষের কঠিন পরিণতি সম্বন্ধে মহানবি সা. ইরশাদ করেছেন, ‘প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার মানুষের আমলগুলো পেশ করা হয় এবং সব মুমিন বান্দার গুনাহখাতা মাফ করে দেওয়া হয়; কিন্তু যাদের পরস্পরের মধ্যে বিদ্বেষ ও দুশমনি আছে, তাদের ক্ষমা করা হয় না। তাদের সম্পর্কে আল্লাহ তাআলা বলেন: তাদের ছেড়ে দাও, যেন তারা ফিরে আসে অর্থাৎ মিলে যায়।’ (মুসলিম)
হিংসার নিষেধাজ্ঞা বিষয়ে হজরত আবু হুরায়রা রা. বর্ণনা করেছেন। রসুল সা. বলেছেন, ‘তোমরা পরস্পরকে হিংসা করো না। একে অপরের প্রতি বিদ্বেষভাব রেখো না। একজন আরেকজন থেকে আলাদা হয়ো না। বরং তোমরা সবাই আল্লাহর বান্দা ভাই ভাই হয়ে যাও’- (মুসলিম : ৬৩৫৩)। প্রতি হিংসা কত বড় গুনাহ তা বোঝাতে গিয়ে ইমাম গাজ্জালী রহ. লেখেন, ‘পৃথিবীতে সর্বপ্রথম পাপ হলো হিংসা। বাবা আদম আ.-এর মর্যাদা দেখে তার প্রতি ঈর্ষান্বিত হয় ইবলিস। ঈর্ষা ও হিংসা থেকেই ইবলিসের মনে জন্ম নেয় অহংকার। আর অহংকারের কারণেই সে আদম আ.-কে সিজদা করতে অস্বীকার করে। ফলে সে চিরদিনের জন্য অভিশপ্ত ও মরদুদ হয়ে যায়।’ আল্লাহ বলেন, (হে নবী আপনি বলুন!) আমি হিংসুকের হিংসা থেকে আশ্রয় চাই, যখন সে হিংসা করে-’ (সুরা ফালাক : ৫)। সব সময় আল্লাহর কাছে এভাবে আশ্রয় প্রার্থনা করতে হবে। কারো ভালো কিছু দেখে তা নিজের জন্য কামনা করা ক্ষতির নয়, যদি এতে অন্যের জন্য অমঙ্গল কামনা করা না হয়। বরং ইবাদত ও আমলের ক্ষেত্রে এমন মনোভাব খুবই প্রশংসনীয়।
একইভাবে নফসের মারাত্মক একটি ব্যাধির নাম লোভ। লোভ মানুষকে অধঃপতনের অতল গহ্বরে নিক্ষেপ করে। নিমজ্জিত করে তাকে পাপসাগরে। একজন লোভী কখনো সুখী হতে পারে না। হজরত আনাস ইবনে মালেক রা: থেকে বর্ণিত, প্রিয় নবি সা: ইরশাদ করেন, যদি আদম সন্তানের জন্য স্বর্ণ ভরা একটা ‘উপত্যকা’ থাকে, তবুও সে তার জন্য দু’টি উপত্যকা কামনা করবে। তার মুখ মাটি ব্যতীত অন্য কিছুতেই ভরবে না। তবে যে ব্যক্তি তওবা করবে, আল্লাহ তার তাওবা কবুল করবেন (সহিহ বুখারি : ৬৪৩৯)।
লোভ বহুপাপের জনক। এ লোভের কারণেই মানুষ এতিমের সম্পদ আত্মসাৎ করে। বোনদের প্রাপ্য অংশ মেরে খায়। প্রতিপক্ষকে খুন করে ক্ষমতা দখল করে। তাই রাসূল সা. লোভ-লালসাকে নিষিদ্ধ ঘোষণা করে বলেছেন, ‘তোমরা লোভ-লালসা থেকে বেঁচে থাকো, কেননা এ জিনিসই তোমাদের পূর্ববর্তীদের ধ্বংস করেছে এবং পরস্পরকে রক্তপাত ঘটানোর ব্যাপারে উসকিয়ে দিয়েছে। লোভ-লালসার কারণেই তারা হারামকে হালাল সাব্যস্ত করেছে।’ (মুসলিম)
আর অহংকার মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। যা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়, মানুষকে হেদায়াত ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যায়। অহংকারের কারণেই আযাযিল ‘বিতাড়িত শয়তানে’ পরিণত হয়েছে। অতীতে পৃথিবীর বহু সম্প্রদায় অহংকারের কারণে ধ্বংস হয়েছে। মানুষ সাধারণত ধন-সম্পদ, ইলম বা জ্ঞান, ইবাদত, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বংশ মর্যাদা ইত্যাদি নিয়ে অহংকার কওে থাকে। অথচ এগুলো সবই আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহ। ¯্রষ্টার দেওয়া নেয়ামত বা অনুগ্রহ দ্বারা অহংকার করার প্রশ্নই আসে না। বরং বান্দার শুকরিয়া আদায় করা উচিত। অহংকারী ও দাম্ভিককে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না।’ (সূরা লোকমান, আয়াত- ১৮)। অহংকার হলো- অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করা, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেন, ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সা. এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোনো কোনো লোক এমন আছে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? উত্তরে রাসূল সা. বললেন, আল্লাহ তা’আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। অহংকার হলো সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট বলে জানা। (সহীহ মুসলিম : ২৭৫)।
পৃথিবীতে অহংকারের পরিণতি লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছু নয়। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার থাকবে, তার জ্ঞান ও বোধশক্তি ততটুকু হ্রাস পাবে। অহংকারী সকলের ঘৃণার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। মানুষ যখন অহংকারী হয়, তখন তার মধ্যে অসংখ্য গুনাহ ও দোষের সমাবেশ ঘটে। অহংকারীকে আল্লাহ তা’আলা তার শাস্তি দুনিয়াতেও দেবেন এবং পরকালেও দেবেন। রাসূল সা. বলেছেন, ‘একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে। অতঃপর একটি সময় আসে তখন তার নাম অহংকারীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন তাকে এমন আযাব গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করছিল।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস নং- ২০০০)। অহংকার জান্নাতে প্রবেশের প্রতিবন্ধক হবে। অহংকারীকে অপমান অপদস্ত করে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
রাসূল সা. এক হাদিসে বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে কারা জাহান্নামে যাবে তাদের বিষয়ে খবর দেব? তারা হলো, অহংকারী, দাম্ভিক ও হঠকারী লোকেরা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৭৩৬৬)। অহংকার করতে পারেন শুধু আমাদের ¯্রষ্টা। কেননা তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘অহংকার হলো আমার চাদর আর বড়ত্ব হলো আমার পরিধেয়। যে ব্যক্তি আমার এ দুটির যে কোনো একটি নিয়ে টানাটানি করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪০৯২)।
সমাজে এই রোগ তিনটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির বড় অন্তরায় হলো লোভ, হিংসা ও অহংকার; যা মানুষের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে, জাগিয়ে তোলে হিং¯্রতা। অহংকার থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে উপকারী ও কার্যকর ওষুধ হলো আল্লাহর নিকট দোয়া ও সাহায্য চাওয়া। এ কারণে রাসূল সা. উম্মতকে দোয়া শিখিয়েছেন এবং তিনি নিজেও সালাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন।
লেখক : বিলাল হোসেন মাহিনী,
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর।
bhmahini@gmail.com