Tuesday, December 24, 2024
Homeসাহিত্যস্মরণ : কবি ফররুখ আহমদ প্রেরণার বাতিঘর

স্মরণ : কবি ফররুখ আহমদ প্রেরণার বাতিঘর


বিলাল হোসেন মাহিনী

বাংলা সাহিত্যে কবি ফররুখ আহমদ এক উজ্জ্বল নক্ষত্রের নাম। তিনি বেঁচে থাকবেন তার অমর অসীম সৃষ্টির মধ্য দিয়ে। তিনি রাষ্ট্রের প্রায় সকল সম্মান পেয়েছেন। পেয়েছেন একুশে পদক, বাংলা একাডেমি পদক, স্বাধীনতা পদক, আমজীপদক, ইউনেস্কো পদকসহ সকল মর্যাদাবান সম্মানে তিনি ভূষিত হয়েছিলেন। কিন্তু স্বাধীনতাযুদ্ধ ও তৎপরবর্তীতে তাঁর লেখনির মাধ্যমে যে আদর্শিক তরুণ সমাজ সৃষ্টি করতে চেয়েছিলেন তাতে বেশ বেগ পেতে হয়। মূলত, ইসলামি রেঁনেসার কবি ও লেখক হওয়ার কারণে বার বার তাকে হোঁচট খেতে হয়েছে।

ফররুখ আহমদ (জুন ১০, ১৯১৮-অক্টোবর ১৯, ১৯৭৪) একজন প্রখ্যাত বাংলাদেশী কবি। এই বাঙালি কবি ‘মুসলিম রেনেসাঁর কবি’ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছিলেন। তার কবিতায় বাংলার অধঃপতিত মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণের অণুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। বিংশ শতাব্দীর এই কবি ইসলামি ভাবধারার বাহক হলেও তার কবিতা প্রকরণকৌশল, শব্দচয়ন এবং বাকপ্রতিমার অনন্য বৈশিষ্ট্যে সমুজ্জ্বল। আধুনিকতার সকল লক্ষণ তার কবিতায় পরিব্যাপ্ত। তার কবিতায় রোমান্টিকতা থেকে আধুনিকতায় উত্তরণের ধারাবাহিকতা পরিস্ফুট। “সাত সাগরের মাঝি” কাব্যগ্রন্থে তিনি যে-কাব্যভাষার সৃষ্টি করেছেন তা স্বতন্ত্র এবং এ-গ্রন্থ তার এক অমর সৃষ্টি।

কবি ফররুখ আহমদ ছিলেন একজন ভাষা সৈনিক। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন নিয়ে তার “মধুর চেয়েও মধুর যে ভাই আমার দেশের ভাষা” গানটি বেশ জনপ্রিয় হয়। সাহিত্যের নানা শাখায় বিচরণ করলেও তার প্রধান পরিচয় ‘কবি’। ফররুখ আহমদ সনেটও রচনা করেছেন। তার রচনায় ধর্মীয় ভাবধারার প্রভাব দেখা যায়। এছাড়া আরবি ও ফারসি শব্দের প্রাচুর্য তার লেখার অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ইসলামি ঐতিহ্যের প্রতি ছিল তার অগাধ আস্থা। তবে তিনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে বাংলার সমর্থন করতেন। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই কবি ফররুখ আহমদ মাসিক সওগাতের আশ্বিন ১৩৫৪ (সেপ্টেম্বর-অক্টোবর ১৯৪৭) সংখ্যায় পাকিস্তান : রাষ্ট্রভাষা ও সাহিত্য নিবন্ধে লেখেন, “গণতান্ত্রিক বিচারে যেখানে সমগ্র পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া উচিত সেখানে পূর্ব পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষাকে পর্যন্ত যাঁরা অন্য একটি প্রাদেশিক ভাষায় রূপান্তরিত করতে চান তাঁদের উদ্দেশ্য অসৎ। পূর্ব পাকিস্তানের সকল অধিবাসীর সাথে আমিও এই প্রকার অসাধু প্রতারকদের বিরুদ্ধে আমার তীব্র প্রতিবাদ জানাচ্ছি।

চল্লিশের দশকে ইংরেজ বিরোধী আন্দোলন তথা স্বাধীনতা আন্দোলনে গনজাগরণ মূলক কবিতা লেখে জনপ্রিয়তা পান কবি ফররুখ আহমদ। তিনি ছিলেন মুসলিম পুনর্জাগরণে বিশ্বাসী। ইসলামী আদর্শ ও আরব ইরানের ঐতিহ্য তার কবিতায় ব্যাঙময় হয়ে উঠে। আমাদের জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বাংলা কবিতায় আরবী, ফারসী শব্দের যে স্বার্থক প্রয়োগ শুরু করেন, মুসলিম রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদ তা আরও বেগবান করেন। ১৯৪৩ সালে বাংলাদেশের দুর্ভিক্ষ নিয়ে ফররুখ আহমদ অসংখ্য কবিতা রচনা করেন। যার সংখ্যা প্রায় ১৯। ১৯৪৩ সালে কিশোর কবি সুকান্ত ভট্টাচার্য ‘আকাল’ নামে একটি সংকলন প্রকাশ করেন। তাতে কবি ফররুখ আহমদের বিখ্যাত ‘লাশ’ কবিতাটি স্থান পায়। দুর্ভিক্ষ নিয়ে অদ্যবধি বাংলা সাহিত্যে ‘লাশ’ এর মত কবিতা আর কেউ লিখতে পারেন নি। দুর্ভিক্ষ নিয়ে ব্যাথিত কবির উচ্চারণ-
“যেখানে পথের পাশে মুখ গুঁজে প’ড়ে আছে জমিনের ’পর;
সন্ধ্যার জনতা জানি কোনদিন রাখেনা সে মৃতের খবর”।
রেনেসাঁর কবি, জাগরণের কবি, ঐতিহ্যের কবি, জাতিসত্তার কবি ফররুখ আহমদ বাংলা সাহিত্যে মহান উচ্চতায় অধিষ্টিত। জাতির আগামী স্বপ্নের জাল বুনতে পথ দেখিয়েছেন এই মহান কবি।

কবি ফররুখ আহমেদের কাব্যগ্রন্থ: সাত সাগরের মাঝি (ডিসেম্বর, ১৯৪৪) । ‘সাত সাগরের মাঝি’ বিষ্ময়কর এক কবিতা গ্রন্থ। ফররুখ আহমদের শ্রেষ্ট গ্রন্থ এটি। প্রকাশের এত বছর পরও এ গ্রন্থ সমানভাবে জাগ্রত ও প্রণবন্ত। এ কাব্যগ্রন্থের অন্যতম একটি জনপ্রিয় ও বিখ্যাত কবিতা হলো ‘পাঞ্জেরী’। মুসলিম জাতীর পিছিয়ে পড়ার, অন্ধকার থেকে পরিত্রাণের কত দেরী তা জানতে কবি উৎসুক।
“রাত পোহাবার কত দেরী পাঞ্জেরী?
এখনো তোমার আসমান ভরা মেঘে?
সেতারা হেলাল এখনো ওঠেনি জেগে?
তুমি মাস্তুলে আমি দাঁড় টানি ভুলে;
অসীম কুয়াশা জাগে শুন্যতা ঘেরী।”

আরও কিছু কাব্য : ‘সিরাজাম মুনিরা’ (১৯৫২), ‘নৌফেল ও হাতেম’ (১৯৬১), ‘মুহুর্তের কবিতা’ (১৯৬৩), ‘ধোলাই কাব্য’ (১৯৬৩), ‘হাতেম তায়ী’ (১৯৬৬), ‘নতুন লেখা’ (১৯৬৯), ‘কাফেলা’ (১৯৮০), ‘হাবিদা মরুর কাহিনী’ (১৯৮১), ‘সিন্দাবাদ’ (১৯৮৩), ‘দিলরুবা’ (১৯৮৪)। শিশু সাহিত্যেও তিনি অতুলনীয় ছিলেন। তার রচিত শিশুতোষ গ্রন্থ হলো- ‘পাখির বাসা’ (১৯৬৫), ‘হরফের ছড়া’ (১৯৭০), ‘চাঁদের আসর’ (১৯৭০), ‘ছড়ার আসর’ (১৯৭০), ‘ফুলের জলসা’ (১৯৮৫)।

পুরস্কার :
১৯৬০ সালে ফররুখ আহমদ বাংলা একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন। কবি ফররুখ আহমদ ১৯৬৫ সনে প্রেসিডেন্ট পদক প্রাইড অব পারফরমেন্স এবং ১৯৬৬ সালে পান আদমজী সাহিত্য পুরস্কার ও ইউনেস্কো পুরস্কার। ১৯৭৭ ও ১৯৮০ সালে তাকে যথাক্রমে মরণোত্তর একুশে পদক ও স্বাধীনতা পদক দেওয়া হয়। আজ ১৯ অক্টোবর কবির মৃত্যু বার্ষিকীতে বিন¤্র শ্রদ্ধা জানাই।

বিলাল মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।

RELATED ARTICLES

Most Popular