বিলাল হোসেন মাহিনী
বাংলাদেশ নাতিশীতোষ্ণ আবহাওয়ার দেশ। শীত প্রধান দেশে থেকে তাই হেমন্তের মাঝামাঝি সময় থেকে শীত অবধি আমাদের দেশে প্রচুর বিদেশী পাখির আগমন ঘটে। যাদেরকে আমরা অতিথি পাখি বলে থাকি। এইসব পাখি সাধারণত খাল-বিল, লেক, হাওড়-বাওড়সহ মিঠা পানির বদ্ধ জলাশয়ে আশ্রয় নেয়। শীতকালে বিদেশী বিভিন্ন প্রজাতির অগনিত পাখির আগমন ঘটে এখানে। শীত মওসুমের বিকেল ৫টা থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জলাধারের আশেপাশের গাছে পাখি পড়ার দৃশ্য ও পাখির কিচির মিচির শব্দ পাখিপ্রেমী দর্শকদের মোহিত করে।
নভেম্বর থেকে এপ্রিল পর্যন্ত অতিথি পাখির কোলাহল থাকে আমাদের দেশে। ঝাঁকে ঝাঁকে অতিথি পাখি ইচ্ছেমত ঘুরে বেড়ায়। কতিপয় শিকারী এইসব অতিথি পাখি নিধনে মেতে উঠে এ সময়। যার ফলে পাখি আসা বন্ধ হয়ে যাচ্ছে দিনদিন। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, এসব অতিথি পাখির আগমন ঘটে উত্তর মেরু থেকে। পৃথিবীর উত্তর মেরু অঞ্চলের দেশ সাইবেরিয়া, আসাম, ফিলিপস, অস্ট্রেলিয়া, রাশিয়া, ফিনল্যান্ড, এন্টার্কটিকা, চীনের লাদাখ অঞ্চলে তাপমাত্রা যখন মাইনাস শূন্য ডিগ্রিতে নেমে আসে, তখন সেগুলোতে দেখা দেয় প্রচন্ড খাদ্যাভাব। তীব্র শীতে পাখির দেহ থেকে পালক খসে পড়ে, তুষারপাত হয়।
সেসব দেশের প্রকৃতি যখন পাখিদের জীবন ধারণের জন্য অনুকূলে থাকে না, তখন পাখিগুলো অপেক্ষাকৃত কম শীত ও অনুকূল প্রকৃতির দেশে অতিথি হয়ে আসে। নাতিশীতোষ্ণ দেশ হিসেবে বাংলাদেশ প্রতিবছর সাদরে গ্রহণ করে নেয়, এসব অতিথি পাখিদের। এদেশ হয়ে ওঠে, তখন অতিথি পাখিদের খাদ্য ও জীবন ধারণের নিরাপদ আবাসস্থল। সৃষ্টিগতভাবে এসব পাখিদের শারীরিক গঠন খুবই মজবুত। তাই অতিথি পাখিরা ৬০০ থেকে ১৩০০ মিটার উঁচু আকাশসীমা পাড়ি দিয়ে উড়ে আসতে পারে। বড় পাখিরা ঘণ্টায় ৮০ কিলোমিটার অনায়াসে উড়তে পারে আর ছোট পাখিরা উড়তে পারে ঘণ্টায় ৩০ কিলোমিটার। দিনে-রাতে মোট ২৪ ঘণ্টায় এরা প্রায় ২৫০ কিলোমটার পাড়ি দিতে পারে। কিছু পাখি বছরে প্রায় ২২ হাজার মাইল পথ অনায়াসে পাড়ি দিয়ে চলে আসে আমাদের এই বাংলাদেশে।
প্রাণীবিজ্ঞানীরা বলছেন, বাংলাদেশে ৭৪৪ প্রজাতির পাখি দেখা যায়। এর মধ্যে ৩০১টি বাংলাদেশে স্থায়ীভাবে বসবাস করে বলে এদের ‘আবাসিক’ পাখি বলা হয়। খ-কালীন সময় নিয়মিতভাবে আসে ১৭৬টি পাখি, যা বাংলাদেশের অতিথি পাখি হিসেবে গণ্য। শীতের প্রচ- প্রকোপ থেকে বাঁচতে আমাদের দেশে অতিথি হয়ে আসে যেসব পাখি- ডেলা ঘেনজি, সোনাজঙ্গ, খুরুলে, বনহুর, মানিকজোড়, চিনাহাঁস, পিয়াংচিনা, রাজহাঁস, গিরিয়া হাঁস, বৈকাল হাঁস, বালিহাঁস, চিতি হাঁস, ভূতি হাঁস, প্রোভায়, নাইরাল ল্যাঙ্গি, গ্রাসওয়ার, নাইবাল, হারিয়াল, ভোলাপাখি, চখাচখি, বুরলিহাস, বারহেড, নারুদ্দি, সিরিয়া পাতিরা, পাথরঘুরানি বাতান, হেরন, খয়রা, জলপিপি, খঞ্জনা, কমনচিল, লালশির, নীলশির, পান্তামুখী, রাজসরালি, বড় সারস পাখি, ছোট সারস পাখি, রাঙ্গামুরি, কবালি, গেন্ডাভার ও গাংকবুতর অন্যতম। বাতাসে শীতের আমেজ লাগতেই আমাদের হাওর, বিল, চরাঞ্চলে দেখা যায় এসব হাজার হাজার অতিথি পাখি।
শীতের প্রকোপ কমে গেলে অতিথি পাখিরা আবার ছুটে চলে নিজ জন্মভূমিতে। বাংলাদেশে অবকাশ যাপনের ইতি ঘটিয়ে আপন ভূমিতে যাওয়ার জন্য আবারও হাজার মাইল পাড়ি দেয় তারা। তবে, যে নিরাপত্তার জন্য এদেশে তারা আসে, দুর্ভাগ্যজনক হলেও সত্য যে কিছু অসাধু মানুষ বিভিন্ন সময় তাদের শিকার ও হত্যা করে থাকে। শিকারীরা হাজার টাকার ফাঁদ, জাল তৈরি করে প্রস্তুত থাকে শীতের আগে থেকেই। বিভিন্ন উপায়ে তারা শিকার করে অতিথি পাখিদের। বিভিন্ন চরাঞ্চলে ধানের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে, কারেন্ট জাল দিয়ে শিকার করে পাখি।শিকারীদের ফাঁদে পড়ে প্রতি বছরই এসব অতিথি পাখির সংখ্যা কমে যাচ্ছে। এভাবে প্রতি বছর অতিথি পাখি নিধন হতে থাকলে প্রকৃতি হারাবে তার নিজস্ব রূপ, বিলুপ্তি ঘটবে বহু পাখি প্রজাতির। তাই আমাদের সবার উচিত অতিথি পাখিদের নিরাপত্তা দানে মানবিক হওয়া। সর্বোপরি, প্রাকৃতিক ভারসাম্য রক্ষা ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণে স্থানীয় প্রশাসনকে সজাগ দৃষ্টি রাখতে হবে।
এই অতিথি পাখি যখন ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে বেড়ায় তখন দলবন্ধ পাখিদের কলতাম আমাদেরকে বিমোহিত করে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের উচিত পাখিদের বাসস্থান সুনিশ্চিত করা। যাতে অতিথি পাখিদের কেউ অত্যাচার করতে না পারে। একইসাথে আমাদেরও সচেতন হওয়া জরুরি।