বিলাল হোসেন মাহিনী
ভাষার জন্য রক্ত ঝরানো বীর বাঙালির ইতিহাসের স্বর্ণখচিত দলিল মাতৃভাষা আন্দোলন। ফেব্রুয়ারির ২১ তারিখ একই সাথে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে বিশ্বব্যাপি পালিত হয়। ১৯৫২ সালের এই দিনে (৮ ফাল্গুন ১৩৫৮, বৃহস্পতিবার) পূর্ব-পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে ছাত্র-জনতার আন্দোলনের পুলিশের গুলিতে শহীদ হন সালাম, বরকত, রফিক, জব্বারসহ নাম না জানা অনেকে। ৫ আগস্ট ২০১০ থেকে ২১ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ স্বীকৃত ‘আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস’ হিসেবে দিনটি সারা বিশ্বে পালিত হয়ে আসছে।
‘মা তোর মুখের বাণী আমার কানে লাগে সুধার মতন’। এই গানটি বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ব্যক্তিগত অনুভূতি নয়, বরং এ গান হলো সর্বকালের সব বাঙালির চিরন্তন অনুভূতি। বাংলা ভাষায় লেখা সর্বশ্রেষ্ঠ কবিতা ও গান। যেটি পরবর্তীতের আমাদের জাতীয় সংগীতের মর্যাদা পেয়েছে।
বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি। বাংলাদেশ ছাড়াও ভারতের পশ্চিমবঙ্গ এবং সারা বিশ্বের বাংলা ভাষাভাষী মানুষের মায়ের ভাষা বাংলা ভাষা। এ ভাষা আমাদের জাতীয় ভাষা। এ ভাষার গভীরতা অসীম। এ ভাষার শিকড় প্রথিত এ দেশের মাটির সাথে, মানুষের সাথে। হাজার বছরের ঋদ্ধ ইতিহাস রয়েছে বাংলা ভাষার। এ ভাষায় গায়ক গায় গান, হৃদয়ের অভিব্যক্তি প্রকাশ করে লেখক কবি-সাহিত্যিকগণ। একুশ নিয়ে রচিত হয়েছে হাজারো কবিতা, গান। চিত্রায়িত হয়েছে সিনেমা, নাটক, শর্টফ্লিমসহ নান ডকুমেন্টারি।
এই বাংলায় কবিতা, নিবন্ধ-প্রবন্ধ, গল্প-উপন্যাস লিখে খ্যাত-বিখ্যাত হয়েছেন শত শত লেখক-কবি। কবি আল মাহমুদ লিখেছেন-
‘ফেব্রুয়ারির একুশ তারিখ/ দুপুর বেলার অক্ত/ বৃষ্টি নামে, বৃষ্টি কোথায়?/ বরকতের রক্ত।
প্রভাতফেরীর মিছিল যাবে/ ছড়াও ফুলের বন্যা/ বিষাদগীতি গাইছে পথে/ তিতুমীরের কন্যা।
চিনতে না কি সোনার ছেলে/ ক্ষুদিরামকে চিনতে ?/ রুদ্ধশ্বাসে প্রাণ দিলো যে/ মুক্ত বাতাস কিনতে ?
প্রভাতফেরী, প্রভাতফেরী/ আমায় নেবে সঙ্গে,/ বাংলা আমার বচন,/ আমি জন্মেছি এই বঙ্গে।’
বাংলা আমাদের মমতাময়ী মায়ের ভাষা, আবেগ-অনুভূতি ও প্রাণের ভাষা, প্রশান্তির ভাষা। যুগ যুগ ধরে বাংলাকে নিয়ে বিভিন্ন কবিতা রচিত হলেও, মধ্যযুগীয় কবি আবদুল হাকীম এর ‘বঙ্গবাণী’ কবিতার মাধ্যমে আমরা প্রথম ভাষার প্রতি ভালোবাসা ও ভাষার মান রক্ষায় প্রতিবাদ করতে শিখি। কবির ভাষায়- ‘যে সবে বঙ্গেতে জন্মি হিংসে বঙ্গবাণী/ সে সব কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি।।
একুশ নিয়ে প্রথম কবিতা লেখেন মাহবুব-উল-আলম চৌধুরী-‘আমি কাঁদতে আসিনি ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’। ১২০ লাইনের দীর্ঘ কবিতার প্রতিটি লাইনে ফুটে উঠেছে ক্ষোভ, গ্লানি, হাহাকার, যন্ত্রণা ও প্রতিবাদের প্রতিচ্ছবি। কবির ভাষ্য- ‘যারা আমার মাতৃভাষাকে নির্বাসন দিতে চেয়েছে/ তাদের জন্যে আমি ফাঁসির দাবি করছি।/ যাদের আদেশে এই দুর্ঘটনা ঘটেছে তাদের জন্য ফাঁসি দাবি করছি।’ ভাষা শহীদের স্মরণীয় করে রাখার জন্য ১৯৫২ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ প্রাঙ্গণে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়। যা ২৬ ফেব্রুয়ারি শাসক গোষ্ঠী ভেঙে ফেলে। প্রতিক্রিয়াস্বরূপ আলাউদ্দিন আল আজাদ ‘স্মৃতিস্তম্ভ’ কবিতাটি রচনা করেন। কবি প্রতিবাদী কণ্ঠে বলেন- ‘স্মৃতির মিনার ভেঙ্গেছে তোমার? ভয় কি বন্ধু আমরা এখনো/ চার কোটি পরিবার/ খাড়া রয়েছি তো। যে-ভিৎ কখনো কোনো রাজন্য/ পারেনি ভাঙ্গতে।’
ভাষা আন্দোলনের প্রকৃতি উপলব্ধি করেই আবদুল গাফফার চৌধুরী সেদিন লিখেছিলেন-‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ কবিতাটি। ছাত্রজীবনে জাতীয় চেতনায় উদ্বুদ্ধ হয়ে কবিতাটি প্রথমে আবদুল লতিফ পরবর্তীতে আলতাব মাহমুদের সুরে বিখ্যাত গানে রূপান্তরিত হয়। ভাষা আন্দোলনের এই গানটি বিবিসির শ্রোতা জরিপে বাংলা ভাষার শ্রেষ্ঠ গানের তালিকায় দ্বিতীয় স্থান লাভ করে। অমর এই গানটি ইংরেজি, হিন্দি, সুইডিশ, ফরাসি, জাপানিসহ প্রায় ১২ টি ভাষায় গাওয়া হয়।
আবু জাফর ওবায়দুল্লাহর কিংবদন্তিতুল্য কবিতা ‘মাগো ওরা বলে’। এ কবিতায় কবি এক দুঃখিনী মায়ের চিত্রকল্প এঁকেছেন-যেখানে লুকিয়ে আছে ভাষা রক্ষার আন্দোলন। কবি বলেন- ‘মাগো, ওরা বলে, /সবার কথা কেড়ে নেবে/ তোমার কোলে শুয়ে/ গল্প শুনতে দেবে না।/বলো, মা, তাই কি হয়? কবি শামসুর রাহমানের একটি স্মরণীয় কবিতা ‘বর্ণমালা, আমার দুঃখিনী বর্ণমালা’। এ কবিতায় কবি উচ্চারণ করেছিলেন-
‘তোমাকে উপড়ে নিলে, বলো তবে, কী থাকে আমার?/ উনিশশো’ বাহান্নোর দারুণ রক্তিম পুষ্পাঞ্জলি/ বুকে নিয়ে আছ সগৌরবে মহীয়সী।
সে ফুলের একটি পাপড়িও ছিন্ন হলে আমার সত্তার দিকে/ কত নোংরা হাতের হিং¯্রতা ধেয়ে আসে।’
কবি মহাদেব সাহা ‘তোমরা কি জানো’ কবিতায় দেখিয়েছেন শহীদদের তাজা রক্তে কিভাবে রাজপথ রঞ্জিত হয়েছিল। রাজপথে রঙিন আলপনা আঁকা এবং কৃষ্ণচূড়ার সমাবেশই শহীদদের রক্তের প্রতিচ্ছবি। কবির ভাষ্য-
‘তোমরা কি জানো সে তো নয় কোনো রঙ ও তুলির ব্যঞ্জনা কিছু/এই আল্পনা, পথের শিল্প শহীদেরই তাজা রক্তের রঙ মাখা!’
একুশ কে নিয়ে বস্তবতার কবি প্রাবন্ধিক গবেষক আবদুল মান্নান সৈয়দ ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ কবিতায় ভাষার সম্মান রক্ষার্থে জনসাধারণের স্লোগানে মুখরিত রাজপথের দৃশ্যপট এঁকেছেন। কবি সংগ্রামী কণ্ঠে বলেন- ‘পাড়ায় পাড়ায় নাটক-ব্রতচারী নাচ-/ মুকুলের মাহফিল-কৃষ্ণচূড়া আর পলাশ ফুল/ আর সবুজের স্বরগ্রাম:কলাপাতা-সবুজ, ফিরোজা, গাঢ় সবুজ, নীল,/ তারই মধ্যে বছরের একটি দিনে/ রাস্তায় রাস্তায় উঠে আসে মুষ্ঠিবদ্ধ হাত” ‘রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই! রাষ্ট্র ভাষা বাংলা চাই!’
ভাষা শহীদদের নাম উচ্চারণ করে সর্বপ্রথম কবিতা লেখেন হাসান হাফিজুর রহমান। সেখানে ঘাতকচক্রের বিরুদ্ধে ঘৃণা প্রয়োগ করে, পরাধীনতার শৃঙ্খল থেকে মুক্ত হওয়ার একাগ্রতা প্রকাশিত হয়। ভাষা আন্দোলনে অতীত ইতিহাসের বীজ রোপিত হয়েছিল যা দেখা যায়, আল মাহমুদের ‘অমর একুশে’ কবিতার মাধ্যমে। যেখানে প্রীতিলতা, ক্ষুদিরাম, তিতুমীরের কন্যার কথা উল্লেখ রয়েছে।
১৯৫৩ সালের মার্চে হাসান হাফিজুর রহমান সম্পাদিত ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি স্মরণিকা প্রকাশিত হয়। পিতার জমি বিক্রি করে নিজের হৃদয়ের সবটুকু আবেগ এবং ভালোবাসা দিয়ে ১৪৯ পৃষ্ঠার সংকলনটি প্রকাশ করেন। যেখানে ১১জন কবির কবিতা সংকলিত হয়। তারা হলেন-হাসান হাফিজুর রহমান, শামসুর রহমান, আলাউদ্দিন আল আজাদ, সৈয়দ শামসুল হক, ফজলে লোহানী, বোরহানউদ্দিন খান জাহাঙ্গীর, আলী চৌধুরী, আবু জাফর ওবায়দুল্লাহ, আব্দুল গনি হাজারী, জামাল উদ্দিন এবং আতাউর রহমান।
এছাড়াও, একুশের প্রেক্ষাপট নিয়ে বিভিন্ন কবি কবিতা রচনা করলেও পল্লীকবি জসীমউদ্দীনের ‘একুশের গান’, সুফিয়া কামালের ‘এমন আশ্চর্য দিন’, মাজহারুল ইসলামের ‘স্বাগত ভাষা’, কায়সুল হকের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহর ‘স্মৃতির মিনার’, আল মাহমুদের ‘একুশের কবিতা’, মোহাম্মদ মনিরুজ্জামানের ‘কৃষ্ণচূড়ার মেঘ’ ওমর আলীর ‘বেদখল হয়ে যা”েছ’, শহীদ কাদরীর ‘একুশের স্বীকারোক্তি’, ড. আবু হেনা মোস্তফা কামালের ‘বর্ণমালা’, সৈয়দ শামসুল হকের ‘একুশের কবিতা’ বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য।
ভাষা আন্দোলনের ওপর নাটক : (১) ‘কবর’ মুনীর চৌধুরী। এটি একুশের প্রথম নাটক। ১৭ জানুয়ারি, ১৯৫৩ সালে কেন্দ্রীয় কারাগারে নাটকটি রচনা করেন তিনি। (২) ‘বিবাহ’ মমতাজ উদ্দিন আহমেদ। মুনীর চৌধুরী রনেশদাস গুপ্তের অনুরোধে নাটকটি লেখেন। একুশের প্রথম সংগঠন ‘তমুদ্দিন মজলিস’। এছাড়াও ‘রক্তে লেখা বাংলা ভাষা’ সাম্প্রতিক একটা পথনাটক। ভাষা-আন্দোলন দানাবেঁধে ওঠার সময়ই এ নিয়ে ১৯৫১ সালে আসকার ইবনে শাইখ লিখেছিলেন নাটক ‘দুর্যোগ’। একইভাবে ভাষা-আন্দোলনের সহযোদ্ধাদের নিয়ে ১৯৫৪ সালে তিনি লিখেছিলেন নাটক ‘যাত্রী’। পরবর্তীতে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে কাইজার আহমেদের লেখা ‘বায়ান্নের শকুর’, মমতাজ উদ্দীন আহমেদের ‘বর্ণচোরা’, রেজ্জাকুল হায়দারের ‘হরমুজ আলীর একুশ, আলী আনোয়ারের ‘বোবা মিনার, রফিউল কাদের রুবেলের ‘ভাষা বদল’, মিলন চৌধুরীর পথনাটক ‘যায় দিন ফাগুনের দিনে’ বেশ আলোচিত হয়। এ ছাড়া ভাষা আন্দোলন থেকে মুক্তিযুদ্ধ প্রতিফলিত হয়েছে শোভাময় ভট্টাচার্যেও ‘একুশের ইতিবৃত্ত’ নাটকে।
একুশের উপন্যাস ঃ (১) আরেক ফাল্গুন লিখেছেন জহির রায়হান। (২) আর্তনাদ লিখেছে শওকত ওসমান। (৩) ‘নিরন্তর ঘন্টাধ্বনি’ লিখেছেন সেলিনা হোসেন। (৪) যাপিত জীবন লিখেছেন সেলিনা হোসেন। একুশের গল্পঃ সূর্য গ্রহণ লিখেছেন জহির রায়হান। ‘মৌন নয়’ লিখেছেন শওকত ওসমান।
ভাষা আন্দোলন নিয়ে প্রামাণ্যচিত্র :
ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত প্রামাণ্যচিত্রগুলোর মধ্যে মস্কো চলচ্চিত্র উৎসবে পুরস্কারপ্রাপ্ত রফিক উদ্দিন আহমেদ পরিচালিত হৃদয়ে একুশ, শবনম ফেরদৌসী নির্মিত ভাষা জয়িতা, রোকেয়া প্রাচীর বায়ান্ন’র মিছিল প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য।
ভাষা আন্দোলনের ওপর নির্মিত সিনেমা :
(১) জীবন থেকে নেয়া (চলচ্চিত্র, ১৯৭০), পরিচালক: জহির রায়হান, অভিনয়ে: রাজ্জাক, সুচন্দা, রোজী সামাদ, খান আতা, রওশন জামিল, আনোয়ার হোসেন প্রমুখ। (২) বাঙলা (চলচ্চিত্র, ২০০৬), পরিচালনা: শহীদুল আলম খোকন, অভিনয়ে: শাবনূর, হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ প্রমুখ। ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সবশেষ ছবি বানিয়েছেন অভিনেতা-নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নামের ছবিটি ভালোই প্রশংসা কুড়িয়ে চলছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎসবে।
একুশের গানঃ (১) ভুলবনা ভুলবনা একুশে ফেব্রুয়ারি ভুলবনা, ভাষা সৈনিক গাজিউল হক (প্রথম)। ২) আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আব্দুল গাফফার চৌধুরী। ৩) সালাম সালাম হাজার সালাম, ফজল এ খোদা। ৪) ওরা আমার মুখের ভাষা কাইড়া নিতে চায়, আব্দুল লতিফ। ইত্যাদি।
তবে সত্যি কথা বলতে কী! যে ভাষার জন্য ছাত্র-যুবকরা বুকের তাজা প্রাণ বিলিয়ে দিলো। সেই ভাষার জন্য, ভাষা আন্দোলন নিয়ে যত গান, কবিতা, গল্প-উপন্যাস, নাটক-চলচ্চিত্র নির্মান হওয়ার কথা তা কিন্তু হয়নি। কেনো হয়নি, তা পাঠক মাত্রেই জ্ঞান রাখবেন।
বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর।
০১৮৪৩-৯০৪৭৯০