Thursday, November 14, 2024
Homeজাতীয়বাংলাদেশের নির্বাচন ও তারুণ্য

বাংলাদেশের নির্বাচন ও তারুণ্য

মোঃআবুহাসান
বাগেরহাট জেলা প্রতিনিধ

বতর্মানে তরুণদের তৃণমূল রাজনীতিতে অংশগ্রহণের তেমন সুযোগ নেই বললেই চলে। এর স্যুতা মেলে জাতীয় সংসদ নিবার্চনের দিকে, তাকালে। বিগণ সময়ে যেসব সংসদ সদস্য নিবাির্চত হয়েছেন, তাদের মধ্যে হাতেগোনা কিছুসংখ্যক তরুণ প্রজন্মের সংসদ সদস্য ছিলেন। আসন্ন নিবার্চনেও যে তেমনটাই ঘটতে যাচ্ছে; তা সুস্পষ্ট করে বলা যায়। জাতীয় নিবার্চনে তরুণদের প্রাথির্তা দেয়া, না দেয়ার নানাবিধ কারণ থাকতে পারে। তবে আমি সেদিকে যাচ্ছি না। আমার কথা হলো, তরুণ নেতারা সংসদে না আসতে পারলে কারা তারুণ্যের ইচ্ছা, আকাক্সক্ষা, হতাশাগুলো বুঝবে? কেননা, তরুণরাই পারে একমাত্র তরুণদের মানসিক পরিস্থিতি বুঝতে। এ ছাড়া তরুণদের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অনেকাংশে প্রগতিশীল হয়। তাদের চিন্তা-চেতনা, ভাব-ধারা উন্নত হয়ে থাকে। সেসব ভাব-ধারা কাজে লাগানোর মাধ্যমে তরুণদেরও দেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় অংশীদারী করানো সম্ভব। দেশের যেখানে এক পঞ্চমাংশ তরুণ, তাদের প্রতিনিধিত্ব করার জন্য তরুণ সংসদ সদস্য প্রত্যাশা মোটেও আকাশ কুসুম ভাবনা নয়।

বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী যে ব্যক্তির বয়স ২৫ বছর হবে, সে-ই সংসদ নিবার্চনে অংশগ্রহণ করার যোগ্যতা অজর্ন করবে। সে হিসাবে তরুণদের অধিকার অনেকাংশে বেশি। একজন পঁচিশোধ্বর্ তরুণ স্বাভাবিকভাবে স্বচ্ছ মন-মানসিকতার অধিকারী। যাদের ঐচ্ছিক প্রণোদনায় দুনীির্ত সংঘটন সহজে সম্ভবপর নয়। মনে হয় তরুণদের দ্বারা দুনীির্তমূলক কাজ করানো সম্ভব নয় বলেই তাদের নিবার্চনে প্রবেশে বঁাধা দেয়া হয়! আর তাই যদি হয়ে থাকে, তবে দেশে বতর্মানে যে রাজনৈতিক অবনতি বিদ্যমান তা ক্রমেই বৃদ্ধি পেতে থাকবে। প্রবীণ রাজনৈতিকদের চাপের মুখে তরুণরা বতর্মানে পদবঞ্চিত। রাজনীতিতে তাদের দীঘর্স্থায়িত্বের কারণে তরুণ রাজনৈতিকদের সংকুলান হচ্ছে না বলে তারা হতাশ হয়ে রাজনীতি বিমুখ হতে চলেছে। বিভিন্ন পরিসংখ্যানে বিষয়টি এসেছে। একই কারণে বাংলাদেশের রাজনীতি এখন পশ্চাৎমুখী। রাজনীতিতে তেমন নতুনত্ব নাই, নীতিগণ তেমন পরিবতর্ন নাই। পুরাতন ভাব-ধারার রাজনীতি দেশীয় উন্নয়ন ব্যবস্থার
বিরাট অন্তরায়।

আমরা দেখেছি, বিগণ সময়ে যেসব তরুণ রাজনৈতিকরা জাতীয় সংসদ নিবার্চন করার সুযোগ পেয়েছেন, তারা প্রত্যেকেই বিপুল ভোটে জয়যুক্ত হয়েছেন। শুধু তাই নয়, তারা জনগণের নিকট যেমন গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে, তেমনি জনগণ তাদের বারবার চেয়েছে। তরুণ রাজনৈতিকদের বিরুদ্ধে তেমন দুনীির্তরও অভিযোগ পাওয়া যায় নাই। বরং তারা সাধ্যমতো জনগণের সেবা দিয়েছেন, নানা বাধ্যবাধকতা অতিক্রম করে এলাকার উন্নয়ন সাধন করেছেন। বাংলাদেশে এমন তরুণ সংসদ সদস্যদের উদাহরণ রয়েছে। (সরাসরি নাম উল্লেখ করে উদাহরণ দিয়ে কারও কাছে ভালো কিংবা কারও কাছে মন্দ হতে চাই না। কেননা এই বিষয়গুলো দেশব্যাপী সমাদৃত।) তিনি বা তারা যে দলের মতাদশীর্ হোক না কেন দেশ ও দশের জন্য তিনি বা তারা অবশ্যই মঙ্গল সাধনকারী।

এ কথা স্বীকাযর্ যে তরুণরা পারে না এহেন কোনো কাজ পৃথিবীতে নেই। এগুলো ধ্রæব স্যু ও প্রমাণিত। দেশের নানাবিধ অধিকার আদায়ের আন্দোলন কারা করে থাকে? কারা ন্যায় ও সত্যের পক্ষে ¯েøাগান দেয়? কারা দেশ ও জাতির ভালোর জন্য অনশন করে? এক বাক্যে বলা যাবে, দেশের তরুণ সমাজরা। তারা চাইলে দেশকে, দেশের শাসনব্যবস্থাকে অচলও করে দিতে পারে। আর আমি মূলত এ কারণেই বলছি, শুধু তরুণদের মন-মানসিকতা ও উদ্দেশ্য বোঝার জন্য জাতীয় সংসদে তরুণ সংসদ সদস্য অতীব প্রয়োজনীয়। একজন প্রবীণের কাছে তরুণদের প্রত্যাশাগুলো বিচার-বিবেচনাহীন কিংবা অহেতুক হতে পারে; কিন্তু একজন তরুণ তা নিজের দৃষ্টিকোণ থেকে হলেও বুঝে ওঠার চেষ্টা করবে। (যেমন, একজন মা-ই কেবল বুঝতে পারে নারীদের প্রসব বেদনা কেমন! পুরুষরা হাজার চেষ্টাতেও বুঝে উঠতে পারে না।) তরুণদের অংশগ্রহণের সুবণর্ সুযোগ দেয়ার মধ্যদিয়ে সংসদীয় ব্যবস্থায় তরুণ কতৃর্ক শাসনব্যবস্থা জোরদার করার সময় চলে এসেছে। এ নিয়ে বিজ্ঞ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের ভেবে দেখা দরকার বলে মনে করছি।

বাংলাদেশের মুষ্টিমেয় তরুণ বতর্মানে বেকারত্বের অভিশাপে জজির্রত। তারা না পারছে পারিবারিক দায়বদ্ধতা কাটিয়ে উঠতে, না পারছে রাজনীতিতে সক্রিয় হয়ে জনগণের সেবা করতে। নিরুপায় হয়ে মাদকাসক্ত, আত্মহত্যার মতো অভিশপ্ত পথ বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছে। কিন্তু এই বিষয়গুলো অনুধাবন করার মতো যেন কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তিই নাই! প্রবীণ রাজনৈতিকরা তাদের দলের তরুণদের দিকে মুখ তুলে তাকায় না এই ভেবে যে যদি তাদের আসন ছেড়ে দিতে হয়। আসলে আমৃতুু রাজনীতি করার অভিলাষের কারণে রাজনীতিতে বতর্মানে প্রবীণদের আধিক্য বণর্নাতীত। তরুণদের দুঃখ কেউ বুঝছে না, সময়মতো চাকরির সুযোগ দিচ্ছে না। বিপরীতে রাজনীতির মাঠে তাদের খঁাটিয়ে নিচ্ছে, অনৈতিক কাজে তাদের জড়িয়ে দিয়ে তারুণ্যকে নিমর্মভাবে খুন করছে। এসব জঘন্য মনোবৃত্ত তরুণদের কাছে স্পষ্ট হওয়ায় তরুণরা সহজে রাজনীতির খাতায় নাম লেখাচ্ছে না। যেখানে তরুণদের চাওয়া-পাওয়ার কোনো মূল্যায়ন হয় না, সেখানে না আসাই উত্তম।

দেশে তরুণ রাজনৈতিকদের নানা রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠন আছে। যেমন, ছাত্রলীগ, ছাত্রদল, যুবলীগ, যুবদল, ছাত্রমৈত্রী ইত্যাদি। তরুণ অবস্থায় এসব অঙ্গসংগঠন থেকে কতজন নেতাকমীর্রা সংসদ নিবার্চনে লড়াইয়ের সুযোগ পেয়ে থাকে? বরং তাদের কাজে লাগিয়ে উচ্চপদের রাজনৈতিকরা ঠিকই ক্ষমতাসীন হয়। তাহলে তরুণদের সংগঠনের আওতায় আনা হয় শুধু প্রবীণদের হাতের লাঠি হিসেবে ব্যবহার করতে? যখন এই বিষয়গুলো তরুণদের কাছে স্পষ্ট হয়ে ওঠে, তখন তারা রাজনীতির অসম বেড়াজাল থেকে মুক্তি পেতে আতর্নাদ করে। কিন্তু মুক্তির কোনো সুযোগ মেলে না। ফলে রাজনীতিতে ছাত্রসন্ত্রাস বেড়ে যায়। তারা ক্ষমতার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে। প্রবীণরা বলে বেড়ায়, তরুণরা সংসদ সদস্য হলে সন্ত্রাস করবে, রাজনীতিতে টিকতে পারবে না। দল ক্ষমতায় আসতে পারবে না ইত্যাদি। বিপরীতে তরুণদের বড় হওয়ার আশ্বাস দেয়। কিন্তু পরিবারকেন্দ্রিকতায় তারা সুযোগ পায় না। তারপর তরুণরা রাজনীতি বিমুখী হয়ে পড়ে।

বিগত এক দশক থেকে কমবয়সী তরুণ, যাদের শিশু বলা যেতে পারে, তারাই রাজনীতিতে বেশ সক্রিয় রয়েছে। এদের অনেকাংশের বয়স আঠারো নয় কিংবা ভোট দেয়ার যোগ্যতাই অজর্ন করে নাই। এদের অনেকে আবার বড় বড় রাজনৈতিক অঙ্গসংগঠনগুলোর পদধারী! যাদের ‘শিশু নেতা’ বলা যেতে পারে। প্রশ্ন হতে পারে, এই সব শিশু রাজনৈতিক মতাদশীর্রা কি কি কাজে লাগে? আমি দেখেছি, প্রথমত যে কাজে লাগে, তা হলো এদের দিয়ে জালভোট, একাধিক ভোট দিয়ে নেয়ানো হয়। এমন দৃশ্য ইতোপূবের্ বিভিন্ন টেলিভিশন মিডিয়ার ক্যামেরায় ধরাও পড়েছে। ক্ষমতাসীন দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততা থাকার কারণে তারা কখনো বিচারের আওতায় আসে নাই, কিংবা নাবালক বলে তাদের রেহাই দেয়া হয়েছে। একবারও প্রশাসন ক্ষতিয়ে দেখে নাই, এরা কাদের পৃষ্ঠপোষকতায় সংবিধানবিরোধী কাজ করছে! দ্বিতীয়ত, মিথ্যা আশ্বাসে সন্ত্রাসী কাজকমের্ সম্পৃক্ত করানো সহজ হয় এবং প্রয়োজনে দল থেকে ছিটকে ফেলে দেয়া যায়। যেমন, এদের কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে ভতির্র সুযোগ, সরকারি চাকরি প্রাপ্তির সুযোগের লোভ দেখানো হয়। যখন তারা অনৈতিক পথে এসব অজর্ন করতে গিয়ে ধরা পড়ে, তখন তাদের বয়কট করা হয়। আসলে রাজনীতিতে তরুণ কমীর্সমথর্কদের যে কত ভাবে ব্যবহার করা যায় তার হিসাব মেলানো মুশকিল। এই সব হিসাব মেলাতে ও তরুণদের প্রকৃত রাজনীতিতে উদ্বুদ্ধ করাতে তরুণ সংসদ সদস্য খুবই জরুরি।

বাংলাদেশে ৩০০টি আসনে ভোটযুদ্ধ হয় আর ৫০টি সংরক্ষিত নারী আসন বরাদ্দ করা থাকে। তরুণদের রাজনৈতিক অধিকারের স্বাথের্ এই ৩৫০টি আসনের সুষম বণ্টন দরকার। যেমন, ৩০০টি আসনের মধ্যে অন্তত ১০০টি আসন তরুণদের মধ্যে এবং ৫০টি নারী আসনের মধ্যে অন্তত ১৫-২০টি আসন তরুণীদের মধ্যে বণ্টন করে দেয়া দরকার। এবং এই প্রক্রিয়াটি বাংলাদেশের সব রাজনৈতিক দলের জন্য প্রযোজ্য। তরুণদের জন্য বরাদ্দকৃত আসনে তাদের জয়ের সম্ভাবনা শতভাগ এই কারণে যে তরুণরা হচ্ছে রাজনীতিতে নতুন মুখ। আর সাধারণ জনগণ রাজনীতিতে নতুন মুখের প্রতি প্রবল আগ্রহ দেখায়। তারুণ্য শক্তি যে এক অমিয় শক্তি তা তরুণদের সংসদে চাওয়ার মাধ্যমে সাধারণ জনগণ ইতোপূবের্ অনেকবার প্রমাণ করেছে। তাই সংসদে মোট আসনের এক-তৃতীয়াংশ তরুণদের পদচারণা কখনই দৃষ্টিকটু হবে না বলে আমি মনে করি। বরং গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থায় এটি একটি অভাবনীয় পরিবতর্ন সাধিত হবে।

পরিশেষে যে কথাগুলো বলতে চাই, শুধু তারুণ্য শক্তি প্রমাণের জন্য নয়, বাংলাদেশের গণানুগতিক রাজনীতির মূলধারার পরিবতর্ন, পরিমাজর্ন ও সংশোধনে এবং সাধারণ জনগণের কাছে রাজনীতির গ্রহণযোগ্যতা প্রমাণে তরুণদের সংসদে যোগদানের সুযোগ দেয়া বতর্মানে অতীব জরুরি হয়ে পড়েছে। যেসব তরুণরা সুষ্ঠু রাজনৈতিক মানসে সংসদ সদস্য হওয়ার লক্ষ্যে নিরলসভাবে নিজ দল, দেশ ও সমাজের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন, তাদের আমার পক্ষ থেকে আন্তরিক অভিনন্দন জানাই। আমি মনে করি, বিপুল সংখ্যক আত্মত্যাগী তরুণ প্রজন্মের হাতে বাংলাদেশের উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ নিহিত, যার উৎকৃষ্ট প্রমাণ আমরা ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে পেয়েছি। তারপরও কি তরুণরা স্বপ্নবঞ্চিত হয়েই থাকবে? এই বিষয়গুলো প্রবীণ রাজনৈতিকদের বুঝে ওঠাপূবর্ক ৬৫-৭০ বছরের পর রাজনৈতিক পদ থেকে অবসর গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। আর কেউ যদি তার ব্যত্যয় ঘটায়, তবে তরুণরা রাজনীতি থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে তাদের বিকল্পভাবে প্রতিহত করবে, তা সুনিশ্চিত। কেননা, তরুণ প্রজন্ম ছাড়া রাজনীতি অসম্ভব। তরুণদের জঁাকজমকতায় জাতীয় সংসদ ভরে উঠুক, আমি একজন তরুণ হয়ে সে প্রত্যাশা ব্যক্ত করি।

RELATED ARTICLES

Most Popular