চলে গেলেন কিংবদন্তী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী!
বাঙালি জাতি হারালো জাতির একজন শ্রেষ্ঠ সন্তানকে ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন।
আমি কর্মস্থল থেকে বাসার দিকে ফিরে যাচ্ছিলাম হঠাৎ করে একটি ফোন কল আসে, ওপর প্রান্ত থেকে আমার বন্ধু আমাকে জানালো ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার আর আমাদের মাঝে নেই। এই কথাটি শোনার জন্য মোটেও প্রস্তুত ছিলাম না, যদিও স্যার বিগত বেশ কিছু দিন ধরে অনেক অসুস্থ। কিন্তু তার পরেও অনেক বুকভরা আশা নিয়ে স্বপ্ন বুনে ছিলাম স্যার হয়তবা আগের মতো আবারও সুস্থ হয়ে আমাদের মাঝে ফিরে আসবেন।
বিগত বেশ কিছু দিন ধরে দৈনিক কয়েকবার ফোন করে স্যারের শারিরীক অবস্থা সম্পর্কে জানার চেষ্টা করেছিলাম স্যার কেমন আছেন। কিন্তু আল্লাহর হুকুমে স্যার আমাদেরকে ছেড়ে আল্লাহর কাছে চলে গেলেন আর এর মাধ্যমে বাঙালি জাতি হারালো ইতিহাসের এক মহাবীরকে।
কিংবদন্তী বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যারের সাথে আমার বেশ কয়েক বার দেখা ও কথা বলার সৌভাগ্য হয়েছিল। গত ২৫ মার্চ ২০২২ সালে স্যার যুক্তরাজ্যে হাউজ অব কমন্সে একটি পুরস্কার গ্রহণের জন্য লন্ডনে এসেছিলেন। সেই দেখাই স্যারের সাথে শেষ দেখা।
তখন স্যারকে অনেক অসুস্থ মনে হচ্ছিল। তখন স্যারকে বলেছিলাম, স্যার আপনি অনেক অসুস্থ আপনি এখানে থেকে চিকিৎসা নিতে পারেন, আপনি লন্ডনে থেকে যান আমাদের কাছে, স্যার বললেন রিয়াদ শোন বিলাতে চিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করার কোন ইচ্ছাই আমার নেই যদি মরতেই হয় তবে নিজ মাতৃভূমিতেই মরব। স্যার বললেন দেশ স্বাধীন হওয়ার পর গত ৫০ বছর ধরে
গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মাধ্যমে বাংলাদেশের চিকিৎসা সেবার মান উন্নত করতে ও দেশের মানুষের জন্য সঠিক চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করতে কাজ করে যাচ্ছি, কিন্তু বিভিন্ন বাঁধার কারনে তা সম্ভব হচ্ছে না।
স্যার বললেন যে স্বপ্ন নিয়ে ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় লন্ডনের আয়েসি জীবন ফেলে দিয়ে নিজের জীবন উৎসর্গ করার জন্য মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলাম সে স্বপ্ন এই ভাবে নষ্ট হতে দিতে পারিনা। জীবনের সবটুকু সঞ্চয় দিয়ে দেশের মানুষের জন্য উন্নত চিকিৎসা সেবা নিশ্চিত করার জন্য কাজ করে যাব। আমি যদি বিলাতে চিকিৎসা নেই তবে আমার দেশের মানুষের অবস্থা কি হবে? তাঁরাও কি বিদেশে চিকিৎসা নিতে পারবে?
ঠিক তাই হলো স্যার যখন কয়েদিন আগে অসুস্থ হলেন তখন স্যারকে বলা হয়েছিল বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নেওয়ার জন্য। কিন্তু স্যার বিদেশে উন্নত চিকিৎসা নিতে অপারগতা প্রকাশ করেন। তিনি তার মাতৃভূমিতেই চিকিৎসা নিয়ে মৃত্যুবরণ করলেন। তার মৃত্যুর সময়ও তিনি নিজ দেশ ও দেশের সাধারণ মানুষের কথা চিন্তা করেছেন।
আমাকে যদি কেউ জিজ্ঞেস করে ড. জাফরুল্লাহ চৌধুরী কে?
আমি বলবো: বীর মুক্তিযোদ্ধা ডা.জাফরুল্লাহ চৌধুরী শুধুমাত্র একজন ব্যক্তি ছিলেন না, তিনি ছিলেন একটি প্রতিষ্ঠান। ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধের শুরু আগে স্যার যখন লন্ডনের রয়্যাল কলেজ অব সার্জনস থেকে এফআরসিএস করছিলেন, তখন মুক্তিযুদ্ধ শুরুর খবর শুনে পড়াশোনা বাদ রেখে দেশের টানে ছুটে আসেন।
লন্ডন থেকে ফিরে ভারতের আগরতলার মেলাঘরে প্রশিক্ষণ কেন্দ্র থেকে প্রথমে গেরিলা প্রশিক্ষণ নেন জাফরুল্লাহ স্যার, পরে সেখানেই ‘বাংলাদেশ ফিল্ড হাসপাতাল’ প্রতিষ্ঠা করে মুক্তিযোদ্ধাদের সেবায় আত্মনিবেদিত হন। তার এই বড় ভূমিকার কথা এখনও স্মরণ করেন মুক্তিযোদ্ধারা।
ইংল্যান্ডে থাকার সময় বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে প্রকাশ্যে পাকিস্তানী পাসপোর্ট ছিঁড়ে ফেলে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে ভারতে গিয়েছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী।
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় থেকে একুশ শতকের করোনা ভাইরাস মহামারি এই পুরো পাঁচ দশকেই কোনো না কোনো ভাবে দেশের সেবায় নিয়জিত ছিলেন ডা: জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার।
বাংলাদেশে অনেকেই তাকে সম্বোধন করেন গরীবের ডাক্তার হিসেবে। জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার স্বাস্থ্য সমস্যার সমাধান করতে চাইতেন সহজভাবে। তিনি বিশ্বাস করতেন, চিকিৎসা বা স্বাস্থ্যসেবার জন্য সব ক্ষেত্রে উচ্চতর ডিগ্রিধারী বা মেডিকেল কলেজ থেকে পাস করা চিকিৎসকের দরকার নেই। স্বল্প শিক্ষিত মানুষকে যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়েও সেবা পাওয়া সম্ভব।
স্বাধীনতার পর দেশের ওষুধের বাজারে বিদেশি ও বহুজাতিক কোম্পানির একচেটিয়া আধিপত্য ছিল। তখন বাজারে চার হাজার ধরনের ওষুধ ছিল। এর প্রায় সবই বিদেশ থেকে আমদানি করা হতো। ওষুধ ছিল সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে। ১৯৮২ সালে ওষুধ শিল্পে নয়ছয় ঠেকাতে জাতীয় ওষুধ নীতি প্রণয়নের আন্দোলন করেন, ১৯৮২ সালের ওষুধনীতি দেশকে ওষুধে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ করে, ওই নীতি প্রণয়নের অন্যতম কারিগর ছিলেন জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার।
বর্তমানে বাংলাদেশ একটি ওষুধ রপ্তানিকারক দেশ। দেশের মানুষকে স্বল্প মূল্যে ওষুধ দেওয়ার জন্য গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র ওষুধ কোম্পানিও প্রতিষ্ঠা করে। বহির্বিশ্বে তাঁর পরিচয় বিকল্প ধারার স্বাস্থ্য আন্দোলনের সমর্থক ও সংগঠক হিসেবে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার ফিল্ড হাসপাতালের সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন ১৯৭২ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র গড়ে তোলেন। শুধু সাস্থ্য সেবাই নয় দেশের সাধারণ মানুষের ভাগ্যের উন্নতির জন্য অনেক দৃষ্টান্তমূলক কার্যক্রম গ্রহণ করেন, যার সফলতা অতিতে ও ভবিষ্যতে সরকারী বা বেসরকারী কর্মকান্ড ও পরিকল্পনাকে প্রভাবিত করে। প্রতিটি কর্মক্ষেত্রে পরনির্ভরশীলতা কমিয়ে আনা ও স্বনির্ভরতা অর্জন করাই ছিল গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের মূল উদ্দেশ্য। স্বাধীন বাংলাদেশে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্র হচ্ছে প্রথম স্বাস্থ্য কেন্দ্র বা হাসপাতাল। ১৯৭৭ সালে গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের সমন্বিত সমাজস্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা সেবা বা জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সর্বোচ্চ জাতীয় পুরস্কার স্বাধীনতা পুরস্কার লাভ করে।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার ছিলেন একজন গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল আস্থাশীল এবং দেশ ও দেশের জনগনের জন্য নিবেদিত প্রাণ। সাহসী দেশ প্রেমিক বীর মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে দেশ ও জাতি হারালো একজন রাজনৈতিক অভিবাবককে।
গণতন্ত্রের প্রতি অবিচল থেকে তিনি দল-মত নির্বিশেষে দেশপ্রেমিক গণতন্ত্রমনা রাজনীতিবিদদের আস্থা ও সম্মান অর্জন করেছিলেন। ছিলেন জাতির একজন অকুতোভয় বীর শ্রেষ্ঠ সন্তান।
তিনি স্বজাতির মুক্তির জন্য জীবনপণ লড়াই করেছেন। তিনি দেশের স্বাধীনতা এবং গণতন্ত্রের জন্য যে ত্যাগ স্বীকার করেছেন তা জনমনে চির ভাস্বর হয়ে থাকবে।
১৯৭৭ সালে দেশের সর্বোচ্চ বেসামরিক সম্মান স্বাধীনতা পুরস্কারে ভূষিত হন জাফরুল্লাহ চৌধুরী। এশিয়ার নোবেল পুরস্কার হিসাবে পরিচিত ‘র্যামন ম্যাগসাইসাই’ পুরস্কার তিনি পান ১৯৮৫ সালে। যুক্তরাষ্ট্রের বার্কলি ইউনিভার্সিটি ২০০২ সালে তাকে ‘ইন্টারন্যাশনাল হেলথ হিরো’ হিসেবে সম্মাননা দেয়।
ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরী স্যার ছিলেন ভয়-ভীতি উপেক্ষা করে সত্যের পথে অবিচল চলার একজন পথিক। তিনি অসীম সাহসের সহিত সাদাকে সাদা এবং কালোকে কালো বলতেন।স্যার একটি কথা বলতেনঃ “আমি মানুষের রাজনীতি করি।”
তার মৃত্যুতে জাতি হারালো একজন দেশ প্রেমিক। রাজনীতি হারালো একজন অভিভাবক। ডা. জাফরুল্লাহ চৌধুরীর শূন্যতা কখনও পূরণ হবার নয়।
মহান আল্লাহর দরবারে স্যারের জন্য দোয়া করি
আল্লাহহুম্মাগ ফিরলাহু ওয়ারহামহু, ওয়া আফিহি ওয়া ফু আনহু; ওয়া আকরিম নুযুলাহু, ওয়া ওয়াসসি মাদখালাহু; ওয়াগসিলহু বিল মায়ি ওয়াস সালজি ওয়াল বারাদি, ওয়ানাক্কিহি মিনাল খাতা-ইয়া কামা ইউননাককাস সাওবুল আব ইয়াযু মিনাদদানাসি; ওয়াবদিলহু দা-রান খায়রান মিন দারিহি, ওয়া আহলান খাইরান মিন আহলিহি; ওয়া যাওজান খাইরান মিন যাওজিহি। ওয়া আদখিলহুল জান্নাতা, ওয়া আইজহু মিন আযাবিল কাবরি ওয়ামিন আযাবিন নার।
অর্থ : হে আল্লাহ্, তাকে ক্ষমা করুন এবং তাকে দয়া করুন। শান্তিতে রাখুন এবং তার থাকার স্থানটিকে মর্যাদাশীল করুন। তার কবর প্রশস্থ করে দিন। বরফ ও তুষারের শুভ্রতা দিয়ে, তাকে গুনাহ থেকে এমনভাবে পরিচ্ছন্ন করে দিন— যেমন ময়লা থেকে সাদা কাপড় পরিষ্কার হয়। তাকে দুনিয়ার বাসস্থানের চেয়ে উত্তম বাসস্থান, পরিবার ও সঙ্গী দান করুন, হে মাবুদ, তাকে জান্নাতে দাখিল করুন, তাকে কবর আর দোজখের আজাব থেকে রক্ষা করুণ। (মুসলিম, হাদিস : ২/৬৩৪)
রাশেদুল হক রিয়াদ
সম্পাদক নবদূত নিউজ চ্যানেল