জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ’র মৃত্যুবার্ষিকী আজ
বিলাল হোসেন মাহিনী
শুধু বাংলাদেশে নয়, বাংলা ভাষাভাষী সমগ্র বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ একজন ধর্মপরায়ণ ব্যক্তি ছিলেন। ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নিরহংকার ও সাদামাটা ছিলেন। ছোটবেলা থেকেই তিনি আদর্শ জীবনযাপন করতেন। ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ (১০জুলাই ১৮৮৫ – ১৩ জুলাই ১৯৬৯) ভারতীয় উপমহাদেশের একজন বাঙালি বহুভাষাবিদ ও দার্শনিক।
তিনি পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার বসিরহাট মহকুমার পেয়ারা গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অত্যন্ত আনন্দোচ্ছল। হাসি ও আনন্দ দিয়ে আশপাশের সবাইকে মাতিয়ে রাখতেন সারাক্ষণ। বন্ধু-বান্ধবরা এজন্য তাঁর নাম দিয়েছিল ‘সদানন্দ’। স্কুলের মাস্টার মশাই চলনে বলনে মুনশিয়ানা দেখে ডাকতেন ‘সিরাজুদ্দৌলা’ নামে। আর আকিকার সময় আত্মীয়-স্বজনের পছন্দে নাম রাখা হয়েছিল ‘ইবরাহিম’। কিন্তু ইতিহাসের পাতায় মায়ের রাখা ‘শহিদুল্লাহ’ নামটা সর্বাধিক প্রসিদ্ধি লাভ করে। মায়ের রাখা নাম অনুযায়ী বাংলা ভাষা ও সাহিত্যে তিনি বরণীয় হয়ে আছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ নামে।
তিনি সর্বদা পড়াশোনায় মগ্ন থাকতে ভালোবাসতেন, অধ্যয়ন আর জ্ঞান-গবেষণায় ছিল তাঁর সমস্ত আনন্দ। এজন্য নিজে নিজের নাম দিয়েছিলেন ‘জ্ঞানানন্দ’। নামের যেমন বাহার ছিল তাঁর, কর্মের বাহার ছিল তারচেয়ে ঢের বেশি। কর্ম প্রচেষ্টায় তিনি হয়ে উঠেছিলেন মুসলিম বাংলার কিংবদন্তী ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী, গবেষক ও শিক্ষাবিদ। ভাষা ও ভাষাতত্ত্বে অর্জন করেছিলেন অগাধ পা-িত্য। আঠারোটি ভাষায় বিস্তৃত ছিল তাঁর এ পা-িত্য। বাংলা, ইংরেজি তো রয়েছেই, সংস্কৃত, আরবি, ফার্সি, উর্দু, হিন্দিতে যথেষ্ট জ্ঞান ছিল তাঁর। এ ছাড়া তিনি রপ্ত করেছিলেন গ্রিক, তামিল, আর ল্যাটিন ভাষাও। আসামি, পাঞ্চাবি, গুজরাটি, মারাঠি, ওড়িষ্যা, কাশ্মীরী, নেপালি, তিব্বতি ইত্যাদি ভাষাও শিখেছিলেন তিনি।
ছাত্রাবস্থায়ই ভাষা শেখার প্রতি ছিল তাঁর ভীষণ ঝোঁক। স্কুল জীবনে তিনি সংস্কৃত আর ফার্সি কবিতা বাংলায় অনুবাদ করতেন। ১৯০৪ সালে প্রবেশিকা পাস করে তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হন। এখান থেকে ১৯০৬ সালে এফএ পাস করেন। এফএ পাশ করে শিক্ষকতায় যোগ দেন যশোর জেলা স্কুলে। পরবর্তীকালে ১৯১০ সালে কলকাতা সিটি কলেজ থেকে সংস্কৃতে বিএ অনার্স ডিগ্রি লাভ করেছিলেন। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি ভর্তি হয়েছিলেন সংস্কৃতে এমএ পড়বেন বলে। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি। ফলে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের তৎকালীন ভাইস চ্যান্সেলর স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের পরামর্শক্রমে তিনি ভর্তি হন তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব নামে নতুন একটি বিষয়ে। সে বছরই এ বিষয়টি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথমবারের মতো যুক্ত হয় এবং শহীদুল্লাহ এ বিশ্ববিদ্যালয়ে এ বিষয়ের প্রথম ছাত্র হিসেবে ১৯১২ সালে এমএ পাস করেন।
পরবর্তীকালে ফ্রান্সের প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভাষাতত্ত্বে ডিপ্লোমা করেন। এবং একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ডিলিট ডিগ্রি লাভের গৌরব অর্জন করেন। অসামান্য প্রতিভাধর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ ছিলেন সুপ-িত ও বহু ভাষাবিদ। ছিলেন মুক্তবুদ্ধির অধিকারী। প্রাচীন ভাষা ও সাহিত্য সম্পর্কে দুরূহ ও জটিল সমস্যার যুক্তিপূর্ণ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণে অসামান্য পা-িত্যের পরিচয় দিয়েছেন তিনি। ১৯১৪ সালে তিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে আইন বিষয়ে ডিগ্রি লাভ করেন। তারপর রুটি-রুজির তাগিদে চট্টগ্রামের সীতাকু-ু হাইস্কুলে প্রধান শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেন। কিন্তু এক বছরের বেশি চাকরি করলেন না। শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে দিয়ে ১৯১৫ সাল থেকে ১৯১৯ সাল পর্যন্ত ওকালতি শুরু করলেন। এ সময় তাঁর সাহিত্য চর্চাও চললো সমান তালে। ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি স্থায়ীভাবে ঢাকা চলে আসেন এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত ও বাংলা বিভাগে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রথম এবং একমাত্র শিক্ষক হিসেবে ওই বছরের জুন মাসে যোগদান করেন। ১৯৪৪ সাল পর্যন্ত টানা তেইশ বছর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছিলেন। পরবর্তীকালেও বিক্ষিপ্তভাবে আরও কয়েক বছর এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনার সঙ্গে জড়িত ছিলেন। ১৯৩৭ সালে সংস্কৃত থেকে বাংলা বিভাগ আলাদা হয়ে গেলে তিনি বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষের দায়িত্ব¡ পালন করেন।
১৯৪৪ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে তিনি বগুড়ার আজিজুল হক কলেজের অধ্যক্ষ হিসেবে চার বছর কাটিয়ে ১৯৪৮ সালে আবার ফিরে এলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং ১৯৫২-৫৪ সাল পর্যন্ত বাংলা ও সংস্কৃত বিভাগের অধ্যাপক ও অধ্যক্ষরূপে দায়িত্ব পালন করেন। পাশাপাশি কলা অনুষদের ডিন ছিলেন এক বছর। ১৯৫৪ সালে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হলে তিনি সেখানকার বাংলা বিভাগের অধ্যক্ষরূপে যোগদান করেন। ১৯৫৫ সালে সেখানেও তিনি কলা অনুষদের ডিন ছিলেন। রাবিতে ‘শহীদুল্লাহ কলা ভবন’ নামে একটি ভবনও নির্মিত হয়েছে তাঁর সম্মানে।
পড়াশোনার খাতিরে তিনি ফ্রান্স, জার্মানি প্রভৃতি দেশ ঘুরে বেড়িয়েছেন। ঘুরেছেন চীন, সৌদি আরবসহ বেশ কয়েকটি দেশে ও শান্তি নিকেতনে গিয়েছেন বেশ কয়েকবার। প্যারিসের সোরবন বিশ্ববিদ্যালয়, জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বাংলা ভাষার সবচেয়ে পুরনো কবিতা সম্পর্কে গবেষণা করে তিনি ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। ১৯৩১ সালে তার প্রথম প্রবন্ধের বই ‘ভাষা ও সাহিত্য’ প্রকাশিত হয়। ১৯৩২ সালে ‘রকমারি’ নামক একটি গল্পের বই প্রকাশ করেন। ১৯৫৩ সালে ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ প্রথম খ- প্রকাশিত হয়। এ সময় ‘আমাদের সমস্যা’ নামে একটি বইও প্রকাশ করেন তিনি। আলাওলের ‘পদ্মাবতী’ আর ‘বিদ্যাপতি-শতক’ নামে দুটি গ্রন্থের সম্পাদনা করেন। বাংলা একাডেমিতে থাকাকালীন তিনি একাডেমির হয়ে বাংলা আঞ্চলিক ভাষার অভিধান ও ইসলামী বিশ্বকোষ সম্পাদনা করেন। ‘বাংলা সাহিত্যের কথা’ (২য় খ-) ও ‘বাংলা ভাষার ইতিবৃত্ত’ নামক বইগুলো প্রকাশিত হয় এ সময়ে। তিনি ওমর খৈয়ামের সাহিত্য বাংলা অনুবাদ করেন। তাঁর রচিত বাংলা ভাষার ব্যাকরণ একটি উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ।
১৯৬৯ সালের ১৩ জুলাই প্রখ্যাত জ্ঞানতাপস ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তাঁর অত্যন্ত পছন্দের স্থান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকাতেই তাঁকে দাফন করা হয়। মুসলিম বাংলার কিংবদন্তী বহুভাষাবিদ ও ভাষাতাত্ত্বিক ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ মাতৃভাষা আর মাতৃভূমির ভালোবাসায় আজীবন বেঁচে থাকবেন বাঙালির হৃদয়ে। এই কামনায়।
লেখক : বিলাল হোসেন মাহিনী, নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর ও পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।