Thursday, October 10, 2024
Homeমতামতসংবিধান, নির্বাচন কমিশন ও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন- বিলাল হোসেন মাহিনী

সংবিধান, নির্বাচন কমিশন ও দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন- বিলাল হোসেন মাহিনী

বর্তমান সংবিধান ও নির্বাচন কমিশনের অধীনে ভোটাধিকার- বিলাল হোসেন মাহিনী

আমাদের নির্বাচন কমিশন একটি স্বাধীন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান। কিন্তু, তারা কতোটা স্বাধীন বা স্বাধীনভাবে তাদের ক্ষমতা প্রয়োগ করতে পারেন, সেটাই আজকের নিবন্ধের আলোচ্য বিষয়। দেখুন, সংবিধান বলছে, “…রাষ্ট্রপতি প্রধান নির্বাচন কমিশনারকে ও অন্যান্য নির্বাচন কমিশনারকে নিয়োগদান করিবেন” [১১৮(১)] এই সংবিধানেই আবার বলা হয়েছে, “…কেবল প্রধানমন্ত্রী ও …প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্টপতি তাঁহার অন্য সকল দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কার্য করিবেন,…” [৪৮ (৩)] এবার দেখুনতো, নির্বাচন কমিশন মূলতঃ কার পরামর্শে গঠিত হলো?

এজন্যই তো, এই নির্বাচন কমিশন সরকারের ইশারা ব্যতীত কোনো দলকে নিবন্ধন প্রদান করতে পারে না। সব শর্ত পূরণ করেও ‘গণসংহতি আন্দোলন’ নিবন্ধন পায় না, তাদেরকে আদালতের দারস্থ হতে হয়। আবার বিএনপি ভাঙতে তৃণমূল বিএনপি’কে নিবন্ধন দেয় সরকারের অনুগত নির্বাচন কমিশন! গঠনতন্ত্রের আলোকে ড. রেজা কিবরিয়াকে অপসরণ করার পরও এই নির্বাচন কমিশন গণ অধিকার পরিষদের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক রাশেদ খানকে চিঠি না দিয়ে অপসারিত রেজা কিবরিয়াকে চিঠি দেয়। কারণ কী? কারণ হলো, তারা সরকারের অনুগত! যাইহোক নির্বাচন কমিশন যে স্বাধীনভাবে তাদের ক্ষমতার প্রয়োগ করতে পারে না সেটাই মূল কথা। তাতে কী! তৃণমূল বিএনপিকে নিবন্ধন দিয়ে কি শহীদ জিয়ার বিএনপি’র চুল পরিমাণ ক্ষতি হইছে? না হয়নি। কেননা সাগর থেকে দু’-চার বালতি জল তুলে নিলে সাগর শুকায় না। তেমনি নূর-রাশেদের বাইরে ‘গণ অধিকার পরিষদ’ নামে যে যাই করুক তাতে গণ অধিকার পরিষদের কিচ্ছু হবে না। আর নিবন্ধন না থাকলে বা পেলে তেমন কিছু হয় না। যার উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ‘জামায়াত’। কেননা, পূর্বের নিবন্ধিত জামায়াতের চেয়ে বর্তমানের নিবন্ধন হারা জামায়াত অনেক বেশি জনপ্রিয় ও শক্তিশালী।

’৯৬-তে আ’লীগ যদি জামায়াত, জাপাসহ বিরোধীদলসমূহকে নিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিতে আন্দোলন না করতো এবং যদি তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন না দিয়ে বিএনপি দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন দিতো, তবে কি আ’লীগ ক্ষমতায় যেতে পারতো? একইভাবে ২০০১-এ কি বিএনপি জোট ক্ষমতায় আসতে পারতো? স্বাধীনতার ৫৩ বছরের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা হলো- নিরপেক্ষ সরকার ছাড়া দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচনে বিরোধীরা ক্ষমতায় আসতে পারেনি।

সংবিধানে নির্বাচন কমিশন :
বাংলাদেশের সংবিধানের সপ্তম ভাগের শিরোনাম ‘নির্বাচন’। এই ভাগের ৯টি আর্টিকেল এবং প্রাসঙ্গিক অন্য ভাগের আর্টিকেল মিলিয়ে আমরা প্রথমে দেখার চেষ্টা করবো এর আওতায় অর্থাৎ এই নির্বাচন কমিশনের অধীনে একটা নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব কিনা। বর্তমান সংবিধান প্রধানমন্ত্রী বা তাঁর দলকে অর্থাৎ সরকারকে রাষ্ট্রপতিকে অপসরণ করার ক্ষমতা দিয়ে রেখেছে। সংবিধানে বলা হয়েছে, “শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতিকে তাঁহার পদ হইতে অপসারিত করা যাইতে পারিবে;…” [৫৩ (১)] এর জন্য “…সংসদের মোট সদস্যের সংখ্যাগরিষ্ঠ অংশের স্বাক্ষর…” [৫৩ (১)], “…স্পীকার সংসদের অধিবেশন আহ্বান করিবেন এবং একটি চিকিৎসা-পর্ষদ গঠনের প্রস্তাব আহ্বান করিবেন…” [৫৩ (২)], “…দশ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি যেন পর্ষদের নিকট পরীক্ষিত হইবার জন্য উপস্থিত হন।” [৫৩ (২)] + “…রাষ্ট্রপতি পর্ষদের দ্বারা পরীক্ষিত হইবার জন্য উপস্থিত না হইয়া থাকিলে প্রস্তাবটি ভোটে দেওয়া যাইতে পারিবে…” [৫৩ (৫)] আর এবং এই প্রস্তাব ভোটে পাশ হবে। কেন হবে? কারণ, সংসদ সদস্য নিজ দলের বাইরে ভোট দিতে পারবেন না। দিলে তার সংসদ সদস্য পদ শূন্য হবে। “কোন নির্বাচনে কোন রাজনৈতিক দলের প্রার্থীরূপে মনোনীত হইয়া কোন ব্যক্তি সংসদ-সদস্য নির্বাচিত হইলে তিনি যদি…সংসদে উক্ত দলের বিপক্ষে ভোটদান করেন, তাহা হইলে সংসদে তাঁহার আসন শূন্য হইবে,…” [৭০]

এবার নির্বাচন কমিশনের স্বাধীনতা ক্ষমতা কতোটুকু দেখা যাক। “নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব পালনের ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকিবেন এবং কেবল এই সংবিধান ও আইনের অধীন হইবেন।” [১১৮ (৪)] অর্থাৎ স্বাধীন, কিন্তু এই সংবিধান ও আইনের অধীন। কেমন অধীনতা দেখা যাক: “সংসদ কর্তৃক প্রণীত যে কোন আইনের বিধানাবলী-সাপেক্ষে নির্বাচন কমিশনারদের কর্মের শর্তাবলী রাষ্ট্রপতি আদেশের দ্বারা যেরূপ নির্ধারণ করিবেন সেইরূপ হইবে;” [(১১৮ (৫)] সংসদে আইন কার ইচ্ছায় প্রণীত হবে এবং রাষ্ট্রপতি সকল আদেশ কার পরামর্শে দিবেন? অবশ্যই প্রধানমন্ত্রীর। [৭০ এবং ৪৮ (৩)]। সুতরাং প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছের বাইরে নির্বাচন কমিশনারদের যাওয়ার সুযোগ নেই।

এবং প্রধানমন্ত্রী কতক্ষণ পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রী থাকবেন? দেখা যাক: “প্রধানমন্ত্রীর উত্তরাধিকারী কার্যভার গ্রহণ না করা পর্যন্ত প্রধানমন্ত্রীকে স্বীয় পদে বহাল থাকিতে এই অনুচ্ছেদের কোন কিছুই অযোগ্য করিবে না।” [৫৭ (৩)] আর সংসদ-সদস্যগণ কতক্ষণ সদস্য হিসাবে বহাল থাকবেন? দেখা যাক: “রাষ্ট্রপতি পূর্বে ভাঙ্গিয়া না দিয়া থাকিলে প্রথম বৈঠকের তারিখ হইতে পাঁচ বৎসর অতিবাহিত হইলে সংসদ ভাঙ্গিয়া যাইবে;…” [৭২(৩)] ২০১৯ সালে গঠিত সংসদের প্রথম অধিবেশন বসেছিল কবে? সম্ভবত ৩০শে জানুয়ারী ২০১৯। সুতরাং সেই নির্বাচনের প্রধানমন্ত্রী পরামর্শ না দিলে এবং সংসদ না ভাঙলে সংবিধান অনুযায়ী আগামী ২৯শে জানুয়ারী ২০২৪ সাল পর্যন্ত বতর্মান সদস্যরা সংসদ-সদস্য।

সুতরাং সে-সময় পর্যন্ত তারা আইন অনুযায়ী সকল সুবিধা ভোগের ও কর্তৃত্বের অধিকারী। আর এই সময়ের মধ্যেই যদি নির্বাচনের বিধান থাকে তাহলে তাদের এসব সুবিধা ও কর্তৃত্ব হাতছাড়া হচ্ছে না। তার মানে সংসদ্ ভাঙার আগেই সংসদ-সদস্য থেকে সকল সুবিধা-ক্ষমতা-প্রটোকল নিয়েই তারা নির্বাচন করতে পারবেন। সুতরাং কোনোভাবেই দুটো-চারটে ওসি-ডিসি-এসপি এসব পরিবর্তন করে “লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড” নামের সুশীল মাঠ আনা যাবে না। সুতরাং এটা স্পষ্ট যে রাষ্ট্রপতি, নির্বাচন কমিশন, সংসদ সকলই শেষ পর্যন্ত গিয়ে পৌঁছাচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর একক কর্তৃত্বে। এখন এমন একক কর্তৃত্বের অধিকারী হয়েও তিনি (প্রধানমন্ত্রী) কি চাইবেন তাঁর দল হেরে যাক?
সে-কারণে আমরা দেখি বাহাত্তর সালের পর থেকে এই সংবিধানের অধীনে নির্বাচন করে কোনো ক্ষমতাসীন দল আজ পর্যন্ত পরাজিত হয়নি, একমাত্র তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমল ছাড়া। কারণ তখন নির্বাচন বিষয়ক এসব সাংবিধানিক বিধানকে আপাতত স্থগিত রাখা হয়েছিল, যেটা উচ্চ আদালতের এক বিতর্কিত ও খ-িত রায়ের মাধ্যমে ক’বছর আগে বাতিল করানো হয়েছে। আর যদি ধরে নিই, সবাই মিলে চাপ দিয়ে একটা গ্রহণযোগ্য নির্বাচন কমিশন আমরা গঠন করাতে সক্ষম হলাম এবং একটি ফেয়ার ইলেকশন হলো, তাতেই কি পরবর্তী সময়ে নাগরিকেরা তাদের ভোটাধিকার ফিরে পাবে? এটার কোনো নিশ্চয়তা নেই।

নিশ্চয়তা যে নেই তার সবচেয়ে বড়ো উদাহরণ ১৯৯১ সালের নির্বাচন কমিশন। যে নির্বাচন কমিশন ১৯৯১ সালে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে বাংলাদেশের ইতিহাসে সবচেয়ে নিরপেক্ষ সংসদ নির্বাচন করতে পেরেছিল, সেই নির্বাচন কমিশনই এক বছর পর বিএনপি সরকারের অধীনে মাগুরায় এমন একটা উপ-নির্বাচন করলো, সেটার নামই হয়ে গেল ‘নির্বাচন মাগুরা মডেল’। সুতরাং আমরা দেখলাম, দেশ চলবে সংবিধান অনুযায়ী আর সংবিধান চলবে প্রধানমন্ত্রীর ইচ্ছানুযায়ী। এবং শুধু নির্বাচন বা বিচারব্যবস্থা নয়, রাষ্ট্রের নাগরিকদের কথায় ভুলিয়ে আর আইনের প্যাঁচে ফেলে যতরকমভাবে অধীনস্ত করে রাখা যায় এবং একইসাথে প্রধান নির্বাহীকে সকল রকম জবাবদিহিতার উপরে তোলা যায়, এই সংবিধান তারই এক প্রকৃষ্ট উদাহরণ হয়ে আছে।

এভাবেই স্বাধীনতার প্রায় অর্ধশত বছর পার হতে চলেছে। আজ এটাকে সংস্কার করা ছাড়া জাতির মুক্তি নেই। সুতরাং সংবিধান সংস্কার ছাড়া কোনো দলীয় সরকারের অধীনে ‘নির্বাচন কমিশন’ এবং ‘জনগন’ কেউই তাদের স্বাধীন ক্ষমতা বা অধিকার প্রয়োগ করতে পারবে না। অধিকিন্তু, সরকার বহিঃবিশ্বকে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ দেখাতে স্পিকার বা আস্থাভাজন অরাজনৈতিক কাউকে প্রধান করে চরমোনাইয়ের জাতীয় সরকারের ফর্মূলা মেনে অন্যান্য দল থেকে কয়েকজন সদস্য নিয়ে নির্বাচনকালীন সরকার করতে পারে। জাতীয় পার্টি, জামায়াত, চরমোনাই দিয়ে কয়েকটি জোট ও নিবন্ধন চাওয়া নতুন ১০-১২টি দলকে নির্বাচনে অংশ নেয়ার শর্তে নিবন্ধন দিয়ে নির্বাচনে আনতে পারে। আর আ’লীগের জোটের ১৪দল তো থাকছেই। তা না হলে, ২০১৬ সালে তৎকালীন প্রতিমন্ত্রী কামরুল ইসলাম বলেছিলেন, ‘স্বাধীনতা বিরোধী জামায়াত নিষিদ্ধে আইন সংশোধন করা হচ্ছে, তাদেরকে (জামায়াত) নিষিদ্ধ করা সময়ের ব্যাপার মাত্র’। মন্ত্রীর ঘোষণার পর ৭ বছর পার হলো, জামায়াত নিষিদ্ধ হলো না। উপরন্তু, তাদেরকে সভা-সমাবেশের অনুমতিও দেয়া হচ্ছে। আগামি ৬ মাস বাংলাদেশ নতুন অনেক কিছু দেখবে। যা দেখেনি স্বাধীনতার ৫৩ বছরে। তবে, আমেরিকার নিষেধাজ্ঞা ও বিএনপি যদি বিরোধী সব রাজনৈতিক দলকে এক দফার দাবিতে ঐক্যবদ্ধ করতে পারে তবে পরিস্থিতি যেকোনো মূহুর্তে পাল্টে যেতে পরে।

বিলাল হোসেন মাহিনী
কবি ও সাংবাদিক
১১-৭-২০২৩

RELATED ARTICLES

Most Popular