করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ততায় সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩২এ উন্নীতকরণের দাবি ও ব্যাকডেট বা বয়স সমন্বয় প্রক্রিয়ার অযৌক্তিকতা তুলে ধরে মাননীয় জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী ফরহাদ হোসেন এমপি নিকট স্মারকলিপি প্রদান করেছে চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্ম। গতকাল রোববার (৪ জুলাই) শেখ ফজলে শামস পরশের মাধ্যমে স্মারকলিপিটি প্রদান করা হয়।
স্মারকলিপিতে উল্লেখ করা হয় যে চাকরি প্রত্যাশী যুব প্রজন্ম, বাংলাদেশের নাগরিক হিসেবে এদেশের সংবিধানকে চূড়ান্ত আইন মনে করি। আমরা গর্বিত এই ভেবে যে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এর সুযোগ্য কন্যা, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুযোগ্য নেতৃত্বের মাধ্যমে বর্তমান সরকার করোনাকালীন পরিস্থিতি শক্তভাবে মোকাবেলা করে চলেছে যা সারা বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত। চলমান কোভিড-১৯ পরিস্থিতি মোকাবেলায় বিভিন্ন সেক্টরে বাংলাদেশ সরকার প্রদত্ত করোনাকালীন প্রণোদনা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থাকে স্থিতিশীল রাখতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।
এখানে উল্লেখ্য যে, কোভিড-১৯ এর ভয়াল থাবা অন্য সকল সেক্টরের মানুষের মতো চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্মকেও বিশেষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। বিগত ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধের ঘোষণার সাথে বন্ধ হয়ে যায় সকল প্রকার সরকারি চাকরির সার্কুলার ও একই সাথে নিয়োগ প্রক্রিয়া। করোনা পরিস্থিতির জন্য দেড় বছর সময়কাল জুড়ে হাতেগোনা কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি প্রকাশিত হয়েছে (সেটিও আবার নির্ধারিত সময়ের চেয়ে দেরিতে) এবং ৪১তম বিসিএস প্রিলিমিনারির মতো মাত্র কয়েকটি পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছে। ফলে দেখা গেছে এই প্রজন্মের অনেকেই তাদের জীবনের দেড় বছর হারিয়ে ফেলেছেন এবং এর স্থায়িত্ব আরও দীর্ঘ হতে যাচ্ছে, যেহেতু দেশে এখন করোনার দ্বিতীয়(আদতে তৃতীয়) ঢেউ চলমান।
করোনার প্রভাবে নুন্যতম কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি আসার পরে এমন চিত্র দেখা গেছে অনেকেই ৫/১০ দিন, এক মাসের জন্য ৪৩তম বিসিএস প্রিলিমিনারি এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের অফিসার পদের নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতে আবেদনই করতে পারেন নাই।
অন্যদিকে চাকরিতে নিয়োগের পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হবার মতো পরিবেশও নেই। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, করোনাকালে চাকরির বিজ্ঞপ্তি প্রকাশের পরিমাণ ৮৭% কমে ১৩% এ উপনীত হয়েছে; প্রায় দুই লাখ পরীক্ষার্থী চাকরিতে আবেদনের যোগ্যতা হারিয়েছেন এই করোনাকালীন অচলাবস্থার মধ্যে যা এদেশের মূলধারার গণমাধ্যমগুলোতে প্রতিনিয়ত বিভিন্ন রিপোর্টে বলা হচ্ছে। অন্যদিকে বেকারত্বের হার ২০% থেকে ৩৫% এ উন্নীত হয়েছে৷ করোনা চলাকালীন সময়ে ২০২০ সালে একটি প্রজ্ঞাপন দিয়ে বলা হয়েছিলো যাদের বয়স শেষ হয়ে যাচ্ছে আসন্ন নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিগুলোতে তাদের আবেদনের সুযোগ দেওয়া হবে। হাতেগোনা কয়েকটি নিয়োগ বিজ্ঞপ্তিতেই সেই সুযোগ দেওয়া হয়েছিল যেগুলো বেশিরভাগই তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণীর চাকরির।
সম্প্রতি আপনার গণমাধ্যমে দেওয়া ব্যক্তব্যে আবারও বয়স সমন্বয় বা ব্যাকডেট এর প্রসঙ্গ উঠে এসেছে যেটা সকল বয়সী শিক্ষার্থীদের জন্য আসলে একটি বৈষম্যমূলক পদ্ধতি হয়ে যায় । ব্যাকডেট দেওয়া বা বয়স সমন্বয়ের মাধ্যমে সকল বয়সী শিক্ষার্থী তথা চাকরিপ্রত্যাশীদের ক্ষতিপূরণ সম্ভব নয়। করোনা শুধুমাত্র ৩০ বছর অতিক্রম করে যাওয়া চাকরিপ্রত্যাশীদেরই ক্ষতি করেনি, বরং সকল বয়সীদের ক্ষতি করেছে। যে ছেলেমেয়েরা বিগত দেড় বছর ধরে অনার্স বা মাস্টার্স পর্যায়ে আটকে আছে তারাও সামনে ভুক্তভোগী হবে। কোভিড শুরুর সময়ে যারা ২৬ বছর বয়সের ছিলো তারা এখন ২৮, ২৭ এখন ২৯, ২৮ এখন ৩০। সরকারি বিধি মোতাবেক সাংবিধানিক যে ৩০ বছর বয়স অবধি আবেদনের সুযোগ পাওয়ার কথা করোনার আঘাত কিন্তু প্রকৃতই সেই সুযোগ দিচ্ছে না। চাকরিতে আবেদনের বয়স স্থায়ীভাবে ২ বছর বাড়িয়ে ৩২ বছর করলে সকলেই তাদের হারিয়ে যাওয়া সময় ২ বছর ফিরে পাবে। আর ৩২ বছর দিলে এই প্রজন্ম আসলে প্রকৃত ৩০ বছর সুযোগ পাবে।
১৯৯১ সালের পূর্বে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ছিল ২৭ যখন গড় আয়ু ছিল ৫৫ বছর ও অবসরের বয়স ছিল ৫৭ বছর। ১৯৯১ সালে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২৭ থেকে করা হলো ৩০ বছর যখন গড় আয়ু ছিলো ৫৭ বছর। এরপর ২০১১ সালে এসে অবসরের বয়স বেড়ে হয় ৫৯ আর মহান মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য হয় ৬০। অবসরের এই ২-৩ বছর বাড়ার কারণে এই সময় তেমন সার্কুলার হয়নি। ১৯৯১ থেকে ২০২১ এই ৩০ বছরে গড় আয়ু ১৬ বছর বৃদ্ধি পেয়ে হয়েছে ৭৩ বছর। কিন্তু চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ে নাই এই ৩০ বছরেও! অবসরের বয়স যেহেতু ২ বছর বৃদ্ধি পেয়েছে সেক্ষেত্রে চাকরিতে প্রবেশের বয়স ২ বছর বৃদ্ধি করলে সেটাও আর সাংঘর্ষিক হয় না। অন্যদিকে সাধারণ শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে সরকারি চাকরিতে প্রবেশ বা আবেদনের বয়সসীমা ৩০ হলেও বিসিএস স্বাস্থ্য ও জুডিশিয়ারি এর ক্ষেত্রে ৩২ বছর।
সরকারি চাকরিপ্রত্যাশী যুব প্রজন্মের দাবিঃ
✔করোনায় শিক্ষার্থীদের প্রায় ২ বছর সময় জীবন থেকে অতিবাহিত হতে চলেছে। তাই করোনাকালীন সরকারের সকল প্রণোদনার পাশাপাশি মুজিববর্ষের ও স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তির বছরে আমরা বেকার যুবকরা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার নিকট ‘প্রণোদনা স্বরূপ’ সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছর করার দাবি জানাচ্ছি।
✔আওয়ামীলীগ সরকারের ২০১৮ সালে নির্বাচনী ইশতেহারে উল্লিখিত ‘প্রতিশ্রুতি’ ছিলো বাস্তবতার নিরিখে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা বৃদ্ধির বিষয়ে যুক্তি সংগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। করোনা জীবনের যে সময় কেড়ে নিচ্ছে এর চেয়ে বড় বাস্তবতা আর কি হতে পারে!
✔ করোনাকালে বিভিন্ন বয়সী শিক্ষার্থীদের বয়সজনিত ক্ষতি পুষিয়ে নিতে ব্যাকডেট বা বয়স সমন্বয় কোন কার্যকরী সমাধান নয়, ৩২ বছরে উন্নীত করলেই সবাই প্রকৃত ৩০ বছরের সুযোগ পাবে।
✔ আওয়ামী লীগ সরকারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ‘Middle income country’তে পরিণত হয়েছে, ‘Digital Bangladesh’এ রূপান্তরিত হয়েছে। উন্নয়নের এই অগ্রযাত্রাকালীন সময়ে এখন বাংলাদেশে চলমান ‘জনসংখ্যাতাত্ত্বিক লভ্যাংশ’ বা Demographic Dividend (কোন দেশের ইতিহাসে একবারই আসে) এর যথাযথ ব্যবহার নিশ্চিতকরণে চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩২ বছরে উন্নীত করা অতীব জরুরী।
উপরোক্ত যৌক্তিক বিষয়গুলো, বিশেষত করোনাকালীন ক্ষতিগ্রস্ততা বিবেচনা করে সরকারি চাকরিতে আবেদন তথা প্রবেশাধিকারের বয়সসীমা ৩২ বছরে উন্নীত করা এই মুহূর্তে অতীব প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি এবং এই বিষয়ে আপনার সুদৃষ্টি ও প্রয়োজনীয় ভূমিকা প্রত্যাশা করছি। এদেশের যুব প্রজন্ম প্রত্যাশা করে তাদের করুণ অবস্থা উপলব্ধি করে আপনি এই ইস্যুটি সঠিকভাবে উপস্থাপন করলে আমরা এই বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার সুদৃষ্টি পাবো। এছাড়া কেবিনেট মিটিং এ উপস্থাপিত হলেও আমাদের মানবিক দাবিটি বাস্তবায়িত হবে বলে আমরা বিশ্বাস করি।
প্রায় তিন মাস সময় ধরে চলমান ‘করোনাকালীন প্রণোদনা হিসেবে চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩২ চাই’ কর্মসূচীতে এমন কোন কার্যক্রম হয়নি যাতে রাষ্ট্র ও সরকারকে বিব্রত হতে হয় বা জনজীবনে সমস্যার সৃষ্টি হয়। কর্মসূচীর অংশ হিসেবে গঠনমূলক প্রক্রিয়ায় আমরা মহামান্য রাষ্ট্রপতি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, স্পীকার, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, আইনমন্ত্রী, শিক্ষামন্ত্রী, পরিকল্পনামন্ত্রী, জনপ্রশাসন প্রতিমন্ত্রী মহোদয় এবং মন্ত্রীপরিষদ, জনপ্রশাসন, মুখ্য সচিববৃন্দ প্রমুখ বরাবর স্মারকলিপি ও খোলা চিঠি প্রদান করেছি। ৩২ ইস্যুতে মাননীয় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, রেলপথ মন্ত্রী, নৌপরিবহণ প্রতিমন্ত্রী, জাতীয় সংসদের চিফ হুইপ, যুবলীগ চেয়ারম্যান ফজলে শামস পরশ, সাংসদ বাহাউদ্দীন বাহার, সাবেক সাংসদ নবী নেওয়াজ, ক্যাপ্টেন মাশরাফি, ব্যারিস্ট্যার সুমন, সুভাষ সিংহ রায়, সোহেল তাজের মতো ব্যক্তিত্বদের সাথে দেখা করে আমাদের বিষয়টি অবগত করে এ বিষয়ে তাঁদের ইতিবাচক মনোভাব পেয়েছি। ৬ই মে ও ২৭ই জুন ঢাকার শাহবাগ চত্বরে করোনা স্বাস্থ্যবিধি মেনে সীমিত পরিসরে মানববন্ধন ও গণস্বাক্ষর কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে। ৩ই জুন বেলা ১২ ঘটিকায় সংসদ ভবন এলাকায় অনুষ্ঠিত হয় মৌন সমাবেশ। ৩২ এর দাবিতে গত ১২ই এপ্রিল, ৬ই জুন এবং ১২ই জুন তিনটি সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে যে সংবাদ প্রায় সকল মূলধারার প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়াতে তুলে ধরা হয়েছে। ১১ই জুন বেলা ৩ ঘটিকায় শাহবাগে প্রায় ১২০০ ছাত্রজনতার উপস্থিতিতে জনসমাবেশ অনুষ্ঠিত হয় যেখানে পুলিশের লাঠিচার্জের মতো ঘটনা ঘটে । চলমান জাতীয় সংসদ অধিবেশনে ইতোমধ্যেই কয়েকজন সাংসদ ‘বয়সসীমা ৩২’ এর বিষয়টি উপস্থাপন করেছেন। মিডিয়াতে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক সরকার দলীয় সাংসদ এ বিষয়ে সহমত প্রকাশ করেছেন।
অতএব, আকুল আবেদন এই যে, আপনি এই রাষ্ট্র ও সরকারের একজন অতি গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি হিসেবে বর্তমান যুব প্রজন্মের ক্ষতিগ্রস্ততা উপলব্ধি করে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা স্থায়ীভাবে ৩২এ উন্নীত করার ব্যাপারে দ্রুততম সময়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে বাধিত করবেন তথা এই প্রজন্মকে ক্ষতিগ্রস্ততা থেকে রক্ষা করবেন।