নবদূত ডেস্ক:
মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের পাকাঘর নির্মাণে অনিয়ম আর দুর্নীতি নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে। ঘরে উঠতে না উঠতেই বাতাসে জানালা উড়ে যাচ্ছে। কোথাও বৃষ্টির পানিতে গলে যাচ্ছে ঘর। আবার কোথাও নির্মাণাধীন অবস্থাতেই ধসে পড়ছে দেয়াল।
প্রধানমন্ত্রীর ঘর উপহার পেয়ে জীবন সায়াহ্নে এসে নিজের জমি, নিজের ঘর পেয়ে যেসব অসহায় মানুষের চোখে হাসির ঝিলিক দেখা দিয়েছিল, তাদের মনের মধ্যে ভয়-আতঙ্ক বাসা বেঁধেছে। এসব ঘর নিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির সঙ্গে জড়িত প্রত্যেকের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন দলের প্রতিবেদন ও দেশ রূপান্তরের সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিদের পাঠানো তথ্য থেকে জানা গেছে, অনিয়মের মধ্যে রয়েছে পরিমাণমতো সিমেন্ট না দিয়ে বালু মিশিয়ে ঘর বানানো, নিম্নমানের সামগ্রী ব্যবহার, সচ্ছলদের বরাদ্দ দেওয়া, ভূমি পরীক্ষা না করে ডোবা-নালা কোনোরকম ভরাট করে ঘর নির্মাণ, বরাদ্দের জন্য কারও কারও কাছ থেকে টাকা আদায় এবং নির্মাণশ্রমিকদের মজুরি অসহায় বরাদ্দপ্রাপ্তদের কাছ থেকে আদায় ইত্যাদি।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একাধিক সূত্র নিশ্চিত করেছে, দেশের বিভিন্ন জেলা থেকে পাওয়া অনিয়মের অভিযোগ আমলে নিয়ে সেসব স্থান পরিদর্শন করেছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের একটি দল। পাশাপাশি গত দুই মাস আগে জেলা প্রশাসকদেরও অনিয়ম অভিযোগের বিষয় তদন্ত করে প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছিল। এরই মধ্যে প্রশাসন থেকে এসব অনিয়মের সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে।
ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ ও ১৪ দলের নেতারা বলছেন, প্রধানমন্ত্রীর আবেগের প্রকল্প হলো এসব ঘর। মুজিববর্ষের সেরা উপহার এটি। আমলারা বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে দেখেননি।
অসহায় মানুষের সঙ্গে যারা এ অনিয়ম করতে পারে তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রীর মুখ্য সচিব ড. আহমদ কায়কাউস বলেন, ‘আশ্রয়ণের অধিকার, শেখ হাসিনার উপহার’এ স্লোগান নিয়ে প্রকল্পটি সামনে এগিয়ে গেছে। এটি প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্নের প্রকল্প। এ প্রকল্পের সঙ্গে মানুষের আবেগ জড়িত। প্রকল্পটি বাস্তবায়নে কোনো ধরনের ত্রুটিবিচ্যুতি, অনিয়ম, দুর্নীতি ও শৈথিল্যের ঘটনা কোনোভাবেই মেনে নেওয়া হবে না। অনিয়ম ও অবহেলার প্রমাণ পাওয়া গেলে শাস্তি পেতেই হবে। কাউকেই বিন্দু পরিমাণ ছাড় দেওয়া হবে না।
আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের প্রকল্প পরিচালক অতিরিক্ত সচিব মাহবুব হোসেন গতকাল বুধবার দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘মুজিববর্ষ উপলক্ষে ২০২০ সালের ১২ অক্টোবর শুরু হওয়া আশ্রয়ণ প্রকল্পের মাধ্যমে এ পর্যন্ত ১ লাখ ১৮ হাজার ৩৮০ জন ভূমিহীনকে দুই কক্ষবিশিষ্ট একটি ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু ঘর নির্মাণকে কেন্দ্র করে আমরা যেসব অভিযোগ পেয়েছি তার প্রত্যেকটিই তদন্ত করা হচ্ছে। দোষীদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।
জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল (জাসদ) সভাপতি ও সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বলেন, ‘একটি বড় উদ্যোগকে যারা নষ্ট করতে চায় তাদের কোনোভাবেই ছাড় দেওয়া যাবে না। কিছু অসৎ আমলা, অসৎ রাজনীতিক, অসৎ ব্যবসায়ী ও অসৎ রাজনৈতিক কর্মী এ চারপক্ষ মিলে তার (প্রধানমন্ত্রীর) উন্নয়নের সুফল ঘরকাটা ইঁদুরের মতো খেয়ে ফেলছে। দুর্নীতির এই ভাইরাস থেকে জাতিকে বাঁচাতে হবে। সবাই এক হয়ে গেছে। এখন আমি বলব দুয়েকজন কর্মকর্তাকে ওএসডি বা সাসপেন্ড করা সমাধান নয়। তাদের কঠোর শাস্তি দিতে হবে। যারাই এর সঙ্গে জড়িত তাদের ছাড় দেওয়া যাবে না। যারা প্রধানমন্ত্রীর স্বপ্ন ও আবেগ নিয়ে ষড়যন্ত্র করে তারা দেশের শত্রু। ’
আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক কৃষিবিদ আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম বলেন, ‘মাঠপর্যায়ের যেসব কর্মকর্তা ও মাঝারি মানের ঠিকাদার বা যারাই জড়িত তাদের বিরুদ্ধে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতে হবে। এই মহৎ উদ্যোগকে তারাই বিতর্কিত করছে, যারা ষড়যন্ত্র করে। মূলত মধ্যম ও নিম্নপর্যায়ের কিছু সরকারি কর্মকর্তার কারণেই এ ধরনের দুর্নীতি হচ্ছে। ’
আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য কর্নেল (অব.) ফারুক খান বলেন, ‘এসব দুর্নীতি করে যারা সরকারকে এবং রাষ্ট্রকে বিতর্কিত করতে চায় অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বর্তমান সরকার দুর্নীতিতে জিরো টলারেন্স, এটাতেও তাই থাকবে। এ সরকার এরই মধ্যে আমলা, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী যারা নিজেদের অনেক বড় মনে করতেন তাদের দুর্নীতি নিয়ে পিছু হটেনি। এবারও হটবে না। ’
কয়েকটি জেলার একাধিক প্রকৌশলী দেশ রূপান্তরকে বলেছেন, আশ্রয়ণ প্রকল্পের শুরুতেই ত্রুটি ছিল। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তাদের (ইউএনও) কাজ ভবন তৈরি করা নয়। কিন্তু তারা রাজনীতিবিদদের খাটো করতে এবং প্রকৌশলীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে এ কাজ করতে গেছেন। কোথায় কতটুকু মাটি ফেলতে হবে এবং কী ম্যাটেরিয়াল দিতে হবে সেটির তোয়াক্কা না করেই তারা দায়সারা গোছের কাজ করেছেন। আবার সেখানেও দুর্নীতি করেছেন। তবে ঘরের জন্য বরাদ্দও কিছুটা কম বলে মন্তব্য করেন এই প্রকৌশলীরা।
আশ্রয়ণ প্রকল্পের কর্মকর্তারাও প্রকল্পে ত্রুটির বিষয়টি স্বীকার করেছেন। তারা বলছেন, কিছু কিছু ক্ষেত্রে ঘর নির্মাণের বেলায় নীতিমালা মানা হয়নি। অনেক ঘর নির্মাণে ত্রুটি রয়েছে, গুণগত মান ঠিক হয়নি। ঘরের দেয়ালে ফাটল দেখা দিয়েছে। পিলার ভেঙে গেছে। দেয়াল ধসে পড়েছে। ঘর নির্মাণে ব্যবহৃত মালামালও ছিল নিম্নমানের। নিচু এলাকায় ঘর নির্মাণ করায় সামান্য বৃষ্টিতেই জলাবদ্ধতার সৃষ্টি হয়েছে। আবার ভূমির মালিকরাও ঘর বরাদ্দ পেয়েছে।
সম্প্রতি দেশের ২২টি জেলার বিভিন্ন উপজেলায় ঘর নির্মাণে নানা ধরনের অনিয়ম পেয়েছে কমিটি। এর মধ্যে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার সাবেক ইউএনও মাহমুদা পারভীন, হবিগঞ্জের মাধবপুর উপজেলার সাবেক ইউএনও তাসনুভা নাশতারান, সুনামগঞ্জের শাল্লা উপজেলার ইউএনও আল-মুক্তাদির হোসেনকে ওএসডি করা হয়েছে। একই সঙ্গে তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা করার সিদ্ধান্ত হয়েছে বলে জানা গেছে। প্রাথমিক তদন্তে এসব কর্মকর্তার বিরুদ্ধে ওঠা অভিযোগের প্রমাণ মিলেছে।
ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়মের সঙ্গে ৩৬টি ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান জড়িত রয়েছেন বলে জানা গেছে। তাদের বিরুদ্ধেও শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণের সম্ভাবনা রয়েছে। এ ব্যাপারে উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের বলা হয়েছে।
এরই মধ্যে ২৯টি উপজেলায় ঘর নির্মাণ নিয়ে অনিয়মের অভিযোগ পেয়েছে তদন্ত কমিটি। এ উপজেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে বগুড়ার আদমদীঘি, কুমিল্লার দেবীদ্বার, খাগড়াছড়ির মহালছড়ি, মাদারীপুরের কালকিনি, লালমনিরহাট সদর, গাজীপুরের শ্রীপুর, সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, নেত্রকোনার খালিয়াজুরী ও মোহনগঞ্জ, কিশোরগঞ্জের কটিয়াদী, জামালপুরের ইসলামপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সরাইল, ময়মনসিংহ সদর, দিনাজপুরের ফুলবাড়ী, হবিগঞ্জের নবীগঞ্জ ও চুনারুঘাট, ভোলার লালমোহন ও দৌলতখান, পাবনার সাঁথিয়া, মানিকগঞ্জের ঘিওর, নাটোর সদর, কুড়িগ্রামের রৌমারী, বরিশাল সদর এবং ঠাকুরগাঁওয়ের হরিপুর।
নির্মাণাধীন ঘরের দেয়াল ধসে চাপা পড়েন ৮০ বছরের মমতাজ : জামালপুরের দেওয়ানগঞ্জ উপজেলার চুকাইবাড়ীর রামপুরা গ্রামের ৮০ বছর বয়সী মমতাজ বেগম মুজিববর্ষে প্রধানমন্ত্রীর উপহার একটি পাকা বাড়ি বরাদ্দ পান। জীবনের শেষ সময়ে এসে জমিসহ পাকা ঘর পাবেন এই স্বপ্নে বিভোর মমতাজ বেগম। বাড়ির নির্মাণকাজ চলছিল। গত ৩ জানুয়ারি দুপুরে হঠাৎ করেই নির্মাণাধীন ঘরের দেয়াল ধসে পড়ে। ২৬ বছরের নাতি রাসেলসহ চাপা পড়েন মমতাজ। স্থানীয়রা গুরুতর আহত অবস্থায় তাদের উদ্ধার করে। পরে বৃদ্ধা মমতাজ বেগমকে দেওয়ানগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয়। তিনি বলেন, ‘আমার ঘর দিছে সরকার। আমি কত খুশি হইছি। আর সেই ঘর আমার মাথাতেই ভেঙে পড়ছে। ’
ওই ঘরের নির্মাণশ্রমিক এরশাদ জানান, ছয় বস্তা বালুর সঙ্গে এক বস্তা সিমেন্ট দিয়ে কাজ করা হয়েছে। মমতাজের স্বামী আমির উদ্দিন বলেন, ‘মাটি বালুর সঙ্গে কম সিমেন্ট দিয়ে কাজ করায় দেয়াল ভেঙে পড়েছে। ’ বৃদ্ধার একমাত্র মেয়ে রাশেদা বলেন, ‘বালু বেশি দিয়ে কাজ করাতেই ঘরটি ভেঙে পড়েছে। ’ একই এলাকায় আনোয়ারা বেগমের নির্মাণাধীন ঘরের বারান্দার দেয়ালও ভেঙে গেছে। আনোয়ারা বলেন, ‘আমি আর ওই ঘরে উঠব না, বাকিটুকু বাতাসে ভেঙে পড়বে। একটু জোরে বাতাস হলেই ঘর ভেঙে পড়ে। ’
সাধারণত এ ধরনের কাজ বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেশের প্রকৌশল প্রতিষ্ঠানগুলোর। গণপূর্ত অধিদপ্তর এবং স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তর এসব কাজ করে থাকে। এছাড়া শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরও ভবন নির্মাণ করে থাকে। সরকারের বিশেষায়িত প্রকল্পগুলোর কোনোটি আবার এমইএস বা মিলিটারি ইঞ্জিনিয়ারিং সার্ভিস করে থাকে। কিন্তু এদের কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে স্থানীয় প্রশাসন এসব ঘর নির্মাণ করছে।
এ প্রসঙ্গে জাতীয় পার্টির মহাসচিব জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু দেশ রূপান্তকে বলেন, ‘আমাদের প্রধানমন্ত্রীর একটি প্রশংসনীয় উদ্যোগ হলো গরিবদের জন্য আশ্রয়ণ প্রকল্প। এ প্রকল্পে কাজ শেষ হওয়ার কিছুদিন পরেই হালকা বৃষ্টিতে ঘর ধসে পড়ার দায় সরকারকেই নিতে হবে। বিশেষ করে এ প্রকল্পের সঙ্গে জড়িত কর্মকর্তা-কর্মচারীসহ সংশ্লিষ্ট সবাইকে বিচারের আওতায় নিতে হবে। আমি দাবি করব, বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে। শুধু কিছু কর্মকর্তাকে ওএসডিই কোনো সমাধান নয়। ’
সুনামগঞ্জের শাল্লায় বৃষ্টির পানিতে ক্ষয়ে যাচ্ছে ঘর : সুনামগঞ্জের শাল্লার ১ হাজার ৪৩৫ গৃহহীন পরিবারকে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর নির্মাণ করে দেওয়া হয়েছে। বৃষ্টি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে এসব ঘর ক্ষয়ে যেতে শুরু করে। অভিযোগ উঠেছে, ইট না দিয়ে যেনতেনভাবে বালু-সিমেন্টের মিশ্রণ দিয়ে ঘরগুলোর মেঝে করে দেওয়া হয়। ঘর পেয়েছেন এমন অনেকেই তদন্ত কমিটির কাছে অভিযোগ করেন, নিম্নমানের ইট, বালু, পাথর ব্যবহার করা হয়েছে এসব ঘর নির্মাণে। আবার নির্মাণসামগ্রী পরিবহনের টাকা গৃহহীনদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কাউকে কাউকে নির্মাণশ্রমিকদের টাকা দিতে বাধ্য করা হয়। গৃহহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়মের অভিযোগ ওঠায় শাল্লার ইউএনওকে কারণ দর্শানোর নোটিস দিয়েছেন জেলা প্রশাসক। এছাড়া দরিদ্র গৃহহীনদের কাছ থেকে পরিবহন ও নির্মাণশ্রমিকদের খরচ বাবদ নেওয়া ৫৭ লাখ ৪০ হাজার টাকাও ফেরত দিয়েছেন ইউএনও।
খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে ঘর প্রতি ৩০ হাজার টাকা আদায় : খাগড়াছড়ির মহালছড়িতে গৃহহীনদের ঘর নির্মাণ প্রকল্পে নানা অনিয়মের অভিযোগ উঠেছে। সরকারি অর্থায়নে নির্মিত হলেও হতদরিদ্রদের কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা পর্যন্ত আদায় করা হয়েছে। স্থানীয়দের অভিযোগ, গৃহহীনদের ঘর দিতে নিয়মবহির্ভূতভাবে ‘নিজের লোকের’ মাধ্যমে মহালছড়ির ইউপি চেয়ারম্যান রতন কুমার শীল এ অর্থ হাতিয়ে নিয়েছেন। তিনি মহালছড়ি উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি।
বেআইনিভাবে অর্থ আদায় ছাড়াও নিম্নমানের সামগ্রী দিয়ে গৃহনির্মাণের অভিযোগ করেছেন ভুক্তভোগীরা। মহালছড়ি ইউনিয়নের ৬নং ওয়ার্ডের চৌংড়াছড়ি হেডম্যানপাড়া এলাকায় ঘর বরাদ্দ পান ৮০ বছর বয়সী পাইয়াপ্রু মারমা। তার স্বজন অংসু মারমা অভিযোগ করে বলেন, ‘এখানে ঘর বরাদ্দ পেতে হলে ইউনিয়ন পরিষদে ৩০ হাজার টাকা জমা দিতে হয়। চেয়ারম্যান রতন শীলের লোক আছে। তাদের কাছে টাকা জমা দেওয়ার পর ঘরটা আসে। ’ পাইয়াপ্রু মারমার ভাই ঘরের জন্য ‘খুশি হয়ে’ ৩০ হাজার টাকা দিয়েছেন। তবে টাকা দেওয়ার পর নিম্নমানের নির্মাণসামগ্রী ব্যবহার করে তৈরি ঘর পেয়েছেন পাইয়াপ্রু মারমা। চৌংড়াছড়ি এলাকা ঘুরে এ অভিযোগের সত্যতা পাওয়া যায়।
চেয়ারম্যান রতন কুমার শীল বলেন, ‘সামনে ইউপি নির্বাচন, তাই আমার ক্লিন ইমেজ ধ্বংস করার জন্য অনেকেই চক্রান্ত করেছে। ঘর নির্মাণের জন্য কারও কাছ থেকে অর্থ আদায় করা হয়নি। কারও কাছ থেকে টাকা নেওয়ার প্রশ্নই আসে না। যদি কাজের মান খারাপ হয়ে থাকে তাহলে শতভাগ ভালো করে দেওয়া হবে। ’
মহালছড়ির ইউএনও জোবাইদা আক্তার এসব অভিযোগের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘নির্মাণাধীন ঘরের অনুমোদন করা হয়। ঘরের জন্য কেউ টাকা নিয়েছেন কি না, আমার জানা নেই। তবে কেউ যদি লিখিত অভিযোগ করেন তাহলে বিষয়টি তদন্ত করে দেখা হবে। ’
ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামীকে মৃত দেখিয়ে ঘর পাওয়ার পর বিক্রি : ভোলার দৌলতখান উপজেলায় প্রথম ও দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫৯টি ঘর হস্তান্তর করা হয়েছে। উপকার ভোগীদের অনেক ঘরের কাজই এখনো শেষ হয়নি। অধিকাংশ ঘরই সচ্ছল ব্যক্তির নামে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। সাদিয়া আফরোজ লিমা নামে এক গৃহবধূর বিরুদ্ধে তার স্বামীকে মৃত দেখিয়ে প্রধানমন্ত্রীর উপহারের ঘর গ্রহণের অভিযোগ উঠেছে। পরে ওই গৃহবধূর ব্যাংক কর্মকর্তা স্বামী ঘরটি পারভীন নামে এক নারীর কাছে বিক্রি করে দেন। মনপুরা উপজেলা সহকারী শিক্ষা কর্মকর্তার বাবার নামেও দ্বিতীয় পর্যায়ে একটি ঘর বরাদ্দ হয়েছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সরেজমিনে দেখা যায়, উপজেলার চরপাতা হাই স্কুলসংলগ্ন পেধা বাড়ির দরজায় ১০টি গৃহনির্মাণ করা হয়েছে। এর মধ্যে নাজমা বেগম নামে এক গৃহহীন নারীর নামে একটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়। তবে ৬ মাস পেরিয়ে গেলেও এখনো কাজ শেষ হয়নি ঘরটির।
এদিকে নির্মাণকাজ অসমাপ্ত রেখেই দৌলতখানের সাবেক ইউএনও কাওসার হোসেনের বিরুদ্ধে বিল উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। তার গাড়িচালক ও গৃহপরিচারিকার নামেও দুটি ঘর বরাদ্দ দেওয়ার তথ্য মিলেছে। এছাড়া উপজেলা ভূমি অফিসের নাজিরের দুজন গৃহপরিচারিকার নামে দুটি ঘর বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে বলে জানা গেছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. আনসার আলী বলেন, ‘ঘর নির্মাণের ব্যাপারে আমার কোনো সংশ্লিষ্টতা নেই। আমার কাজ হচ্ছে ডিজাইন অনুযায়ী শ্রমিকদের কাজ বুঝিয়ে দেওয়া। এসব ঘর বরাদ্দের কোনো কাগজপত্রও আমার কাছে নেই। সাবেক ইউএনও কাওসার হোসেন স্যার কাজগুলো বাস্তবায়ন করেছেন। ’
এ বিষয়ে দৌলতখানের সাবেক ইউএনও কাওসার হোসেন দেশ রূপান্তরকে বলেন, ‘আমার নির্মিত ৪২টি ঘরের মধ্যে টিন সংকটের কারণে একটি ঘরের কাজ সম্পন্ন করা সম্ভব হয়নি। তবে এত অল্প খরচে এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। ’ বিতরণে অনিয়মের ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, ‘অতি অল্প সময়ের মধ্যে বণ্টন করায় পর্যাপ্ত যাচাই-বাছাই করা সম্ভব হয়নি। ’
জেলা প্রশাসক মো. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী বলেন, তদন্তসাপেক্ষে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অনিয়মে জড়িতের শাস্তির উদ্যোগ : মুজিববর্ষ উপলক্ষে আশ্রয়ণ প্রকল্পের অধীনে ভূমিহীনদের ঘর নির্মাণে অনিয়মে জড়িত ১৮০ জনের বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। তাদের মধ্যে সরকারি কর্মকর্তা ও ইউপি চেয়ারম্যান রয়েছেন। ইতিমধ্যে পাঁচ কর্মকর্তাকে ওএসডি ও দুই কর্মকর্তার বিরুদ্ধে বিভাগীয় মামলা হয়েছে। এ নিয়ে জেলা প্রশাসকরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। এছাড়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিদর্শন দলের সদস্যরা। তাদের প্রতিবেদনে ঘর নির্মাণে অনিয়মের চিত্র উঠে এসেছে।
ঘরপ্রতি অর্থ বরাদ্দ : দুই রুমের আধাপাকা ঘরের প্রতিটির নির্মাণব্যয় ১ লাখ ৭১ হাজার টাকা। মালামাল পরিবহনের জন্য অতিরিক্ত ৪ হাজার টাকা দেওয়া হচ্ছে। সম্পূর্ণ প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হচ্ছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যলয়ের আশ্রয়ণ-২ প্রকল্পের আওতায়। অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে তিনটি স্থান থেকে। আশ্রয়ণ-২ প্রকল্প, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় এবং ভূমি মন্ত্রণালয়ের গুচ্ছ-গ্রাম প্রকল্প থেকে।
জাতীয় স্বার্থে এই প্রতিবেদনটি দেশ রূপান্তর থেকে হুবহু প্রকাশ করা হল।
মূল নিউজ লিংক: https://www.deshrupantor.com/first-page/2021/07/08/303031?fbclid=IwAR20H3-E0eoGS7VVLodPI-Td36DBaSiWr34W0A_P9g9TO_n4PB9nbvSN8OA