সম্প্রতি ইসরাইলের তৈরি স্পাইওয়্যার পেগাসাস নিয়ে বিশ্বজুড়ে চলছে তুমূল আলোচনা সমালোচনা। এর মাধ্যমে বিভিন্ন দেশে সাংবাদিক, রাজনীতিক, ব্যবসায়ী, অধিকার কর্মী এবং আরো অনেকের ওপর গোপন নজরদারি নিয়ে এক অনুসন্ধানী রিপোর্ট প্রকাশ হয়েছে।
যেসব দেশে এই প্রযুক্তি ব্যাপকহারে ব্যবহার করে নজরদারি চালানো হয়েছে সেই তালিকায় বাংলাদেশের নাম এখনো পর্যন্ত আসেনি।
তবে বিভিন্নভাবে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন এবং ইন্টারনেটের উপর নজরদারি চালিয়ে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে ঘায়েল করা এবং ব্যক্তিগত গোপনীয়তা লঙ্ঘনের অভিযোগ রয়েছে।
২০১৩ সালের অক্টোবর মাসের ঘটনা এটি, যখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা এবং বিরোধী দলীয় নেত্রী খালেদা জিয়ার মধ্যকার টেলিফোন আলাপ ফাঁস হয়ে ইন্টারনেটে ছড়িয়েছিল।
বাংলাদেশের দুইজন শীর্ষ স্থানীয় রাজনৈতিক ব্যক্তির- যাদের একজন প্রধানমন্ত্রী – ফোনালাপ কিভাবে ফাঁস হলো, কারা রেকর্ড করলো সে প্রশ্নের পরিষ্কার জবাব এখনো মেলেনি।
তবে সন্দেহের তীর সরকারের দিকেই। কারণ, এই ফোনালাপ ফাঁস নিয়ে বিরোধী পক্ষ আপত্তি তুললেও সরকারের দিক থেকে এর বিরুদ্ধে কোন কথা বলতে শোনা যায়নি।
সেই ঘটনার পর থেকে গত আট বছরে বাংলাদেশে একের পর এক ফোনে নজরদারির ঘটনা সামনে এসেছে। ফোনে নজরদারির এসব ঘটনা অনেকের মাঝেই বেশ উদ্বেগ তৈরি করেছে।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দেখা গেছে, রাজনীতিবিদ এবং সাংবাদিকসহ অনেকের মোবাইল ফোন কথোপকথনের রেকর্ড সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়েছে।
কারা এই কাজ করছে সেটি নিয়ে অনেকের মধ্যেই উদ্বেগ এবং চিন্তা বাড়ছে।
নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, মোবাইল ফোনে আড়ি পাতা কিংবা ইন্টারনেটে নজরদারির বিষয়টি প্রয়োজন হয় রাষ্ট্র ও মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য।
বিভিন্ন সন্ত্রাসী গোষ্ঠী এবং অপরাধী-চক্রের গোপন পরিকল্পনা আগে থেকে জেনে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেবার জন্যই নজরদারির প্রয়োজন। তবে বিষয়টি হতে হবে আইনগত কাঠামোর ভেতর দিয়ে।
বাংলাদেশ ইন্সটিটিউট অব পিস এন্ড সিকিউরিটিজ-এর চেয়ারম্যান অবসরপ্রাপ্ত মেজর জেনারেল এ. এন. এম মুনিরুজ্জমান বলেন, রাষ্ট্রের নিরাপত্তা যেমন গুরুত্ব আছে, তেমনি ব্যক্তির নিরাপত্তাও গুরুত্ব আছে। রাষ্ট্রের নিরাপত্তার জন্য কিছু তথ্য সংগ্রহ করার প্রয়োজন হতে পারে। সেটা হতে হবে আইনগত ভিত্তির উপরে।
বিশেষ করে সন্ত্রাসী এবং উগ্রপন্থী কার্যক্রম ঠেকানোর জন্য এ ধরনের ব্যবস্থার প্রয়োজন হতে পারে বলে উল্লেখ করেন জেনারেল মুনিরুজ্জমান।
রাষ্ট্রীয় সংস্থার মাধ্যমে নজরদারি কিংবা আড়িপাতার বিষয়টি এখন আর গোপন কোন বিষয় নয়। পশ্চিমা বিশ্বের অনেক দেশেই কোন নাগরিকের ফোনে আড়িপাতার প্রয়োজন হলে আদালত থেকে অনুমোদন নিতে হয়।
কিন্তু বাংলাদেশে আড়িপাতার বিষয়টি নিয়ে কোন আইন আছে কি?
এমন প্রশ্নে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক সাংবাদিকদের বলেন, “সকল রাষ্ট্রের, সকল সরকারের এই ধরনের আড়িপাতার জন্য আইনে একটা বিধান রাখা হয়। জরুরী অবস্থায় বা প্রয়োজনে এই বিধান প্রয়োগ করতে হয়। এই আইন কাজে লাগিয়ে তখন তারা আড়ি পাতে।”
“আমাদের দেশেও বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ আইনে এ ধরনের বিধান আছে। এছাড়া ডিজিটাল সিকিউরিটি অ্যাক্টেও এই বিধান আছে। কিন্তু এই দুটো আইনের ক্ষেত্রেই সরকারি অনুমতি নেবার প্রয়োজন আছে।”
ব্যক্তিগত গোপনীয়তা এবং স্বাধীনতা নিয়ে যে উদ্বেগ তৈরি হয়েছে, তার পাশাপাশি সরকার-বিরোধীদের নজরদারির জন্যই এসব প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ব্যক্তিস্বাধীনতার দর্শনের উপর ভিত্তি করেই গণতন্ত্র টিকে থাকে।
নজরদারির কারণে ব্যক্তিগত গোপনীয়তা ক্ষুণ্ণ হলে সার্বিকভাবে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়াও ব্যহত হয় বলে মনে করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাব্বির আহমেদ।
“ব্যক্তির যে স্বাধীনতা, তার প্রিভেসি বিপর্যস্ত হচ্ছে। অনেকে মোবাইল টেকনোলজি সম্পর্কে ভীত হয়ে গেছে। যেখানে সেখানে তারা মোবাইল ব্যবহার করতে ইচ্ছুক নয়। একসময় আপনি মতামত নেবার জন্য লোকও পাবেন না,” বলেন অধ্যাপক আহমেদ।
কিছু শর্তসাপেক্ষে বাংলাদেশে ব্যক্তিগত গোপনীয়তার রক্ষার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে সংবিধানে।