আফগানিস্তানের সামরিক ও রাজনৈতিক দৃশ্যপট খুব দ্রুত পাল্টাচ্ছে। অন্যদিকে পর্দার আড়ালে আঞ্চলিক ও বিশ্ব শক্তিগুলোর দৌড়ঝাপ চলছে আফগানিস্তানের ভবিষ্যত ও দেশটিতে তাদের নিজ নিজ স্বার্থের রূপরেখা ঠিক করতে। তবে এই প্রতিযোগিতায় সম্ভবত হেরে যাচ্ছে ভারত। আফগানিস্তান তালেবানের নিয়ন্ত্রণ নেয়ার পর সেখানে ভারতের পররাষ্ট্রনীতি নিয়ে নয়াদিল্লি দ্বিধা ও সংশয়ে ভোগছে। আর এই সুযোগে অন্যরা বৃদ্ধি করছে নিজেদের প্রভাব।
আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্র চলে যাওয়ায় যুদ্ধবিধ্বস্তু দেশটিতে ভূমিকা রাখার সুযোগ পেয়েছে তাদের দুই কূটনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বী রাশিয়া ও চীন। যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়ার পর তৈরি হওয়া শূন্যতা পূরণে সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে চীন। কৌশলগতভাবে এগিয়ে থাকায় গত কিছুদিনে চীন সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে আফগানিস্তান ইস্যুতে। অন্যদিকে আঞ্চলিকভাবে প্রভাবশালী হলেও এক্ষেত্রে পিছিয়ে পড়েছে ভারত।
মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন নয়াদিল্লি সফরে এসে আফগানিস্তানে চীনের ভূমিকাকে ইতিবাচক হিসেবে উল্লেখ করেছেন। তবে ব্লিঙ্কেন যেদিন ভারত সফর করেছেন, সেই একই দিন চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী ওয়াং ই বৈঠক করেছেন তালেবান নেতা মোল্লা বারাদারের সঙ্গে। ওই বৈঠকের বিষয়ে মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে- সেটি হলো, আফগানিস্তানের বর্তমানে যে ধরনের প্রভাবশালী, স্থিতিশীল ও শক্তিশালী মিত্র দরকার বেইজিং কি তা হতে পারবে? বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মনে করা হচ্ছে বেইজিং সেই দায়িত্ব নিতে সক্ষম। কারণ, তার বাণিজ্যিক ও কূটনৈতিক সামর্থ নিয়ে প্রশ্ন তুলবে না কেউ। পাশাপাশি সামরিক দিক থেকেও চীন এখন বিশ্বে সুপার পাওয়ার।
এই বিষয়টি নিয়ে সবচেয়ে বেশি উদ্বেগে পড়েছে ভারত। আফগানিস্তানে পাকিস্তান কিংবা চীন- কোনো রাষ্ট্রের কার্যক্রমেই নির্ভাবনায় থাকতে পারছে না দিল্লি। ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর বলেছেন, আমরা মনে করি না, আফগানিস্তানের ভবিষ্যত যুদ্ধের মাঠে ঠিক হওয়া উচিত। কিন্তু সেটি যদি আলোচনার টেবিলেও ঠিক হয়ে তাতে ভারত খুব বেশি ভূমিকা রাখতে পারবে না বলেই মনে হয়।
একদিকে পাকিস্তানের সঙ্গে তালেবানের ঘনিষ্ঠতা, অন্যদিকে এই অঞ্চলে চীনের প্রভাববিস্তারকারী আঞ্চলিক কূটনীতি- দুটোই ভারতের জন্য চিন্তার বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। বাণিজ্যিক স্বার্থ এবং আফগানিস্তানের খনিজ সম্পদের কারণে দেশটিকে চীন তার বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়িটিভের সঙ্গে যুক্ত করতে চাইবে। তবে বেইজিংয়ের কাছে তার চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে চীনের উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় উইঘুর মুসলিমদের তালেবানের প্রভাব থেকে মুক্ত রাখা। বহু বছর ধরে নির্যাতিত হওয়া উইঘুর মুসলিমরা যে তালেবানের সংস্পর্শ পেলে প্রতিবাদী হয়ে উঠতে সেটি বুঝতে চীনের সমস্যা হওয়ার কথা নয়।
ভারতের অশোকা ইউনিভার্সিটির মিডিয়া স্টাডিজ বিভাগের প্রধান ও এনডিটিভির সাবেক ফরেন অ্যাফেয়ার্স এডিটর মায়া মিরচাঁদানীর বিশ্লেষণ হচ্ছে, গত মাসে তাজিকিস্তানের রাজধানী দুশানবেতে অনুষ্ঠিত সাংহাই কো-অপারেশন অর্গনাইজেশনের সম্মেলনের ফাঁকে চীনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী তালেবানের সঙ্গে বৈঠকে গোষ্ঠিটির প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন, উইঘুরদের ইস্ট তুর্কিস্তান ইসলামিক মুভমেন্টের সঙ্গে কোনো ধরনের সম্পর্ক না রাখার জন্য।
চীন আরো চায় পাকিস্তানের চীনের বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান ও তার কর্মীদের যাতে টার্গেট না করে তালেবানের পাকিস্তান শাখা বা তেহরিক-ই তালেবান পাকিস্তান নামের সংগঠনটি।
চীন যদি আফগানিস্তানে স্থিতিশীলতা আনতে মধ্যস্ততা করতে শুরু করে তাহলে ভারতের কী হবে সেই প্রশ্ন এখন নয়াদিল্লির জন্য বড় চিন্তার কারন হয়ে উঠেছে। আফগানিস্তান থেকে যুক্তরাষ্ট্রের চলে যাওয়া কখনোই সমর্থন করেনি ভারত। কারণ তালেবানের সঙ্গে ভারতের সম্পর্ক ঐতিহাসিকভাবে ভালো নয়। ২০১৮ সালে কাতারের রাজধানী দোহায় আফগান শান্তি প্রক্রিয়া শুরু হওয়ার পর থেকে ভারতের নীতি ছিলো ‘ওয়েট এন্ড ওয়াচ’ অর্থাৎ অপেক্ষা ও পর্যবেক্ষণ করা; কিন্তু তালেবানের ক্রমশ অগ্রগতির পর ভারত বুঝতে পেরেছে যে, এখন আর তাদের তালেবানকে এড়িয়ে চলার সুযোগ নেই। তাছাড়া চীন, পাকিস্তানের মতো দেশগুলো আফগানিস্তানের রাজনীতিতে জড়িয়ে গেলে নয়াদিল্লিরও যে দূরে থাকা ঠিক হবে না সেটিও তারা বুঝে গেছে।
আফগানিস্তানে রয়েছে ভারতের অনেক কূটনৈতিক ও ভূরাজনৈতিক স্বার্থ। যে কারণে ইতোমধ্যেই তালেবানের সঙ্গে ভারতীয় কর্মকর্তাদের কয়েক দফা বৈঠকের খবর পাওয়া গেছে। কিন্তু প্রকাশ্য সম্পর্ক স্থাপনে ভারত এখনো অগ্রসর হয়নি।
তালেবান নিয়ে নয়াদিল্লির যে অস্বস্তি তা সহজে কাটবে বলে মনে হয় না। তালেবানের শাসন পদ্ধতি ও পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক- এই দুটি কারণে গোষ্ঠিটির প্রতি ভারতের আস্থার ঘাটতি রয়েছে। আফগানিস্তানের সঙ্গে নতুন করে ভারতের সম্পর্ক স্থাপনের বিষয়ে পাকিস্তান হস্তক্ষেপের চেষ্টা করবে কিনা সেটি নিয়ে ধোয়াশা রয়েছে নয়াদিল্লির কাছে।
এক দিকে পাকিস্তান চীনের মিত্র, অন্য দিকে তালেবানের সঙ্গে তাদের রয়েছে পুরনো সম্পর্ক। তাই ভারতীয় বিশ্লেষকদের ধারণা ভারত তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপনে আগ্রহী হলে সেক্ষেত্রে পাকিস্তান বাধা দেয়া কিংবা প্রভাব বিস্তারের মতো কিছু করতে পারে। তারপরও ভারতীয় বিশ্লেষকরা মনে করেন, তালেবানের সঙ্গে সর্ম্পক স্থাপনে ভারতের দ্রুত উদ্যোগী হওয়া উচিত।
আফগানিস্তানের নিযুক্ত ভারতের সাবেক রাষ্ট্রদূত বিবেক কাটজু প্রশ্ন তুলেছেন, ভারত কেন এখনো তালেবানের মতো শক্তিশালী একটি পক্ষের সঙ্গে সরাসরি উচ্চ পর্যায়ের যোগাযোগ করতে চাইছে না। সাবেক এই কূটনীতিক মনে করেন, গোয়েন্দা পর্যায়ের গোপন বৈঠক কখনোই প্রকাশ্য বৈঠকের দাবি পূরণ করতে পারে না। তাই আফগানিস্তানে ভারত হেরে যাচ্ছে বলেই তার অভিমত।
চীন যেহেতু আফগানিস্তানের যুক্তরাষ্ট্রের শূন্যস্থান পূরণ করতে চাইছে, এক্ষেত্রে তালেবানের সঙ্গে যোগাযোগের ক্ষেত্রে কখনো কখনো তারা পাকিস্তানকেও ব্যবহার করছে। যুক্তরাষ্ট্র চলে গেলেও তাদের যে সামান্য প্রভাব এখানে রয়ে গেছে সেটুকু তারা শান্তি চুক্তি বাস্তবায়নে কাজে লাগাতে চেষ্টা করতে পারে। কিন্তু তা ভারতের জন্য খুব বেশি উপকারী নাও হতে পারে। তাই ভারতে ভাবতে হবে তার নিজের মতো করেই। নিজের পথও নিজেকেই খুজে নিতে হবে। তবে এক্ষেত্রে ভারতের সামনে খুব কম বিকল্প রয়েছে।
ভারত হয়তো তালেবানের সঙ্গে প্রকাশ্যে সম্পর্ক স্থাপনে বিব্রত বোধ করতে পারে। কিন্তু কাবুলের অন্য শক্তিগুলোর ওপর তাদের কতটা প্রভাব বা সুসম্পর্ক রয়েছে সেটিও ভেবে দেখতে হবে। তালেবান বিরোধী গোষ্ঠিগুলোকে কাজে লাগিয়ে ভারত যদি আফগানিস্তানে নিজস্ব প্রভাব বৃদ্ধি ও দেশটিতে স্থিতিশীলতা আনতে ভুমিকা রাখতে পারতো তবে সেটি তাদের জন্য সম্মানজনক ও লাভজনক হতো।
কিন্তু বাস্তবতা হলো- দেশটিতে এখন তালেবানের সঙ্গে টক্কর দেওয়ার মতো শক্তি কেউ নেই। আবার কম শক্তির যারা আছে, তাদের ওপরও ভারতের খুব একটা প্রভাব নেই। কাজেই তালেবানের সঙ্গে সম্পর্ক স্থাপন করা ছাড়া ভারতের সামনে আর কোনো পথ খোলা নেই বলেই মনে হচ্ছে। তালেবানের মুখপাত্র সোহাইল শাহীন এনডিটিভির সঙ্গে সাক্ষাতকারে বলেছেন ভারত সরকারকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে তালেবান তাদের বন্ধু হবে না শত্রু হবে। ভারত যদি অস্ত্র গোলাবারুদ দিয়ে আফগানিস্তানের জনগনের বিরুদ্ধে অস্থিরতা তৈরি করে তাহলে তা শত্রুতা হিসাবে বিবেচনা করা হবে। আর যদি আফগানিস্তানের উন্নয়ন ও অগ্রগতিতে ভুমিকা রাখে তা কখনই শত্রুতা হতে পারে না। তালেবান মুখপাত্রের এই বক্তব্যর মধ্যে ভারত-তালেবান সম্পর্কের পথনির্দেশ লুকিয়ে আছে।