বিলাল মাহিনী
মানুষের দুশ্চিন্তা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো মানসিক চাপ। পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি চাপের ফলে আমাদের দিন দিন দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পায়, কোনো একসময় গিয়ে সে দুশ্চিন্তা আত্মাহরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতা ও যান্ত্রিক দুনিয়ায় আবেগ, মায়া-মমতা, সম্মান-শ্রদ্ধা-স্নেহ-ভালোবাসা এবং নীতি-নৈতিকতাবোধ জাদুঘরে নির্বাসনের পথে। পরমতসহিষ্ণুতা, অপরের অধিকার রক্ষা, অপরের ভালোলাগা বা খারাপ লাগার বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়া ইত্যাদি বিষয়কে এড়িয়ে যাওয়ায় একে অপরের কাছ থেকে দুশ্চিন্তায় থাকে মানুষ। কেননা, আমরা এখন প্রায় সবাই দুশ্চিন্তাগ্রস্থ। দুশ্চিন্তা এখন আমাদের মনের রোগ থেকে দেহের রোগে রূপান্তরিত হয়েছে। আজকের সমাজ ও বাস্তবতায় এটা মেনে নিতে হবে যে- বর্তমান বিশ্ব প্রতিযোগিতার বিশ্ব। সবাই আমরা এখন অর্থ ও শক্তির প্রতিযোগিতায় নেমেছি। প্রতিযোগিতায় যারা সফল হচ্ছি, তারাও যেমন দুশ্চিন্তায় আছি তেমনি সফল যারা হইনি তারা তো দুশ্চিন্তার মহাসাগরে ভাসছি। সফল ব্যক্তিরা বাধাহীন চিত্তে আরও সাফল্য চায়, তারা ক্ষ্যান্ত নয়। ঘুম নেই চোখে। তাছাড়া দুশ্চিন্তা করছে এই ভেবে যে, পেছন থেকে কে যেন এসে তাদের সাফল্যের মুকুটটা ছিনিয়ে নেয়। আর ব্যর্থ মানুষগুলো দুশ্চিন্তায় আছে এই ভেবে যে, তাদের জীবন-জন্ম সব বৃথা গেল; ওরা সফল হলো আমরা কেনো সফল হতে পারলাম না ইত্যাদি ইত্যাদি। ঠিক এমনি করে বস্তুবাদকে সামনে রেখে বাস্তবিক পক্ষে আমরা ইট-পাথরের দুনিয়ায় সবাই দুশ্চিন্তায় আছি। কী হবে, কী করতে হবে ইত্যাদি ভেবে ভেবে।
আমাদের প্রিয় স্বদেশ বাংলাদেশ এখন উন্নয়নশীল দেশ। উন্নয়নের মহাসড়কে হনহন করে চলছে সোনার বাংলা। এই উন্নয়নের ফলে কয়েকটি শ্রেণির সৃষ্টি হচ্ছে। প্রথমত ব্যবসায়ী এলিট শ্রেণি, যারা রাজনৈতিক প্রশ্রয় নিয়ে দেশের সব সেক্টর নিয়ন্ত্রণ করছেন। ইচ্ছেমত দাম বাড়াচ্ছেন পণ্যের, ভেজাল ও দুর্নীতিতে ভরে উঠছে সমাজ এবং রাষ্ট্র। সমাজ পচে যাক, মানুষ মরে যাক, তাকে কী! তাদের টাকা চাই, আরও চাই। এরফলে নিষ্পেষিত হচ্ছেন মধ্যবিত্ত ও নি¤œবিত্ত সাধারণ মানুষ। তৈরি হচ্ছে অসম শ্রেণি সমাজ। এছাড়াও শিক্ষিত চাকরিজীবী শ্রেণি আছে, আছে শিক্ষিত বেকার শ্রেণি। চাকরিজীবী (উদ্যোক্তা, ব্যবসায়ী) শ্রেণি আছে কীভাবে আরও সফলকাম হওয়া যায়। কীভাবে অন্যকে পেছনে ফেলা যায়। কীভাবে নিজেকে টিকিয়ে রাখা যায় ইত্যাদি দুশ্চিন্তায়। আর বেকার শ্রেণি এখন কূলকিনারাহীন দরিয়ায় হাবুডুবু খাচ্ছেন। তারা বাঁচবে কী করে, এ দুশ্চিন্তাই সবসময় মনের মধ্যে ঘুরপাক খায়। এ দুশ্চিন্তার ফলে নানা ধরনের জটিল ও কঠিন রোগে আক্রান্ত হচ্ছি আমরা, তার হিসাব বাংলাদেশের হাসপাতাল আর ক্লিনিকগুলোতে গেলে বোঝা যায়। বর্তমানে মানুষ যেসব রোগে বেশি বেশি ভুগছে তার বেশিরভাগই দুশ্চিন্তার কারণে। বর্তমান সময়ে ৭০ শতাংশ মানুষের মৃত্যু ঘটছে এই দুশ্চিন্তাজনিত রোগে। সুতরাং দুশ্চিন্তাকে খাটো করে দেখার কোনো সুযোগ নেই।
এখনকার দিনে উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো ধোঁকাবাজি। মানুষের মধ্যে কোনো নৈতিক মূল্যবোধ ও সততা কাজ করে না। ধর্মীয় অনুশাসন নিম্নপর্যায়ের চলে গেছে, এমনকি কোনো কোনো ক্ষেত্রে নেই বললে চলে। ফলে সকলেই সবসময় অন্যজনকে নিয়ে দুশ্চিন্তায় থাকে। এজন্য আমাদের কীভাবে দুশ্চিন্তা থেকে নিজেকে মুক্ত রাখা যায়, সে পথে হাঁটতে হবে। তাহলে আমাদের শরীর ও মন ভালো থাকবে। পরিশ্রম করতে হবে। তাতেই সাফল্যের শীর্ষে উঠা যাবে। সর্বোপরি অল্পে তুষ্ট থাকতে হবে। স্বল্প ধন-সম্পদ, স্বল্প আহার ও স্বাভাবিক পোশাক এবং প্রসাধনী ব্যবহার করতে হবে। এজন্য ধর্মীয় অনুশাসনসহ মূল্যবোধ ঠিক রাখার উপায় সংবলিত বই পড়া, নাটক-সিনেমা ইত্যাদি দেখতে হবে। অশালীন ও কুরুচিপূর্ণ ভিডিও দেখা থেকে বিরত থাকতে হবে।
না পাওয়ার বেদনা ও দুশ্চিন্তা থেকে আত্মহত্যা একটা সামাজিক ব্যাধিতে রূপান্তরিত হয়েছে। দেশে প্রায়ই আত্মহত্যার সংবাদ শোনা যায়। উচ্চ মাধ্যমিক ও বিশ্ববিদ্যালয় পড়–য়াদের আত্মহত্যার প্রবণতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতিক পত্র-পত্রিকার পরিসংখ্যানও তাই বলছে। নানা সংবাদমাধ্যমের তথ্য ঘেঁটে দেখা গেছে, বেশিরভাগ মানুষ দুশ্চিন্তা থেকেই আত্মহননের পথ বেছে নিয়েছেন।
দেশের অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও বিশ্ববিদ্যালয় এখন শিক্ষিত বেকার তৈরির কারখানা হয়ে গেছে। একটি গবেষণায় দেখা গেছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে যতজন শিক্ষার্থী পড়াশোনা করছে তার প্রায় ৬০ শতাংশ বেকার জীবনযাপন করছে। অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজ-মাদরাসার ক্ষেত্রেও ওই একই অবস্থা। হয়তো শতকরা হার কিছুটা কম হতে পারে। তবে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার অন্যতম কারণ হলো সঠিক শিক্ষার অভাব। অবাক করা বিষয় হলো, বিদায় অনুষ্ঠানের মতো দিনেও শিক্ষার্থীরা ডিজে ড্যান্স ও অশালীন অঙ্গভঙ্গি করছে। নানা অপকর্মেও জড়াচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষায় নৈতিকতার দীক্ষা বাড়াতে হবে। শিক্ষা ক্ষেত্রে আমূল পরিবর্তন না এলে শিক্ষিত বেকার আরও বেশি হবে, ফলে শিক্ষার্থীদের আত্মহত্যার হার অনেক বৃদ্ধি পাবে। বাংলাদেশে সরকারের এখন উচিত- প্রচলিত শিক্ষাব্যবস্থার পরিবর্তে নৈতিকতা সমৃদ্ধ কর্মমুখী শিক্ষার ব্যবস্থা করা। শিক্ষার পরিবর্তন এনে যদি মানুষকে কর্মমুখী করা যেতে পারে, তাহলে দুশ্চিন্তার পরিমাণ কমবে, কমবে আত্মহত্যার পরিমাণও।
দুশ্চিন্তা বৃদ্ধির প্রধান কারণ হলো মানসিক চাপ। পারিবারিক, সামাজিক ইত্যাদি চাপের ফলে আমাদের দিন দিন দুশ্চিন্তা বৃদ্ধি পায়, কোনো একসময় গিয়ে সে দুশ্চিন্তা আত্মাহরণের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এ ক্ষেত্রে পারিবারিক, সামাজিক ও রাষ্ট্রীয়ভাবে সুশিক্ষাকে কাজে লাগাতে হবে। রাষ্ট্রীয় ও সামাজিকভাবে দুশ্চিন্তা, আত্মহত্যা ও শিক্ষা এ তিনটি বিষয়ের ওপর গবেষণা চালাতে হবে এবং এখান থেকে উত্তরণের উপায় খুঁজে বের করতে হবে। ব্যাপক প্রচার ও প্রচারণা চালিয়ে মানুষকে সচেতন করতে হবে।