Friday, November 22, 2024
Homeধর্মলাইলাতুল বরাতের গুরুত্ব : মুসলিম উম্মাহ’র করণীয় বর্জনীয়

লাইলাতুল বরাতের গুরুত্ব : মুসলিম উম্মাহ’র করণীয় বর্জনীয়


-বিলাল হোসেন মাহিনী

আমরা এই উপমহাদেশের মুসলিমগণ যেটাকে ‘শবে বরাত’ বলে আখ্যায়িত করে থাকি, মূলতঃ পবিত্র কুরআন ও সহিহ হাদিসে সেটাকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা শাবান মাসের মধ্য রজনী বলে সম্বধন করা হয়েছে।

‘শবে বরাত’ পালনের ক্ষেত্রে মুসলিম উম্মাহ’র মধ্যে দু’ ধরণের বিশ্বাস ও আচার দেখা যায়। একপক্ষ শবে বরাত পালন করাকে ‘বিদয়াত’ বলেন অন্য পক্ষ খুব জোরেশোরে মহা ধুমধামের সাথে এ দিবসটি বিশেষতঃ রাতটি পালন করেন। দু’পক্ষেরই শরীয়তের আলোকে কিছু যুক্তি ও দলিল আছে। তবে আমাদের আলোচনা হলো ‘এ রাতের মাহাত্ম্য আছে ঠিকই তবে সীমালঙ্ঘনের সুযোগ নেই।’ যেমন, পাঁচ ওয়াক্ত সালাত ও রমজানের রোজা (সিয়াম) ফরজ ইবাদত; এখন কেউ যদি নিসফি মিন শাবান তথা শবে বরাতের ইবাদতকে উক্ত দুই ফরজের চেয়ে বেশি গুরুত্ব প্রদান করেন, তবে তা হবে সীমালঙ্ঘন এমনকি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিদয়াতের শামিল।

আমাদের দেশে এ রাতকে ‘শবে বরাত’ বলা হয়। ফারসী ভাষায়, শব অর্থ রজনী। আর বরাত অর্থ ভাগ্য। সুতরাং শবে বরাতের অর্থ দাঁড়ায়, ভাগ্য রজনী। মূলত: এই পরিভাষাটি কুরআন বা সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত নয়। বরং একটি আয়াতের অসতর্ক ব্যাখ্যা থেকেই এ ধরনের নামকরণ হতে পারে। সূরা দুখানের ৪নং আয়াতে বলা হয়েছে, “নিশ্চয় আমি এটি নাযিল করেছি বরকতময় রাতে; নিশ্চয় আমি সতর্ককারী। সে রাতে প্রত্যেক প্রজ্ঞাপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত অনুমোদিত হয়”।
‘বরকতময় রাত’ বলতে অসাবধানতাবশত: কেউ কেউ মধ্য শাবানকে বুঝেছেন। অথচ এর দ্বারা যে রমাদান মাসে অবস্থিত কদরের রাতকে বুঝানো হয়েছে, তা একটি অকাট্য বিষয়। এজন্যই ইবনুল কায়্যীম (র.) বলেন, “এটি অকাট্যভাবে কদরের রাত্রি। কারণ আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “নিশ্চয়ই আমি কুরআনকে কদরের রাত্রিতে নাযিল করেছি”। আর যারা শাবানের মধ্যরাত ধারণা করছে, তারা আসলে ভুল করছে”। ইবনে কাসিরও বলছেন, “যারা শাবানের মধ্য রাত্রিকে বরকতময় বা ভাগ্যরজনী বলছেন, তারা বিভ্রান্তি মধ্যে রয়েছেন। বরং এটি যে রমাদান মাসের একটি রাত, সে ব্যাপারে কুরআনের ভাষা সুস্পষ্ট”।

এভাবে প্রমাণিত হয়, কুরআনের মধ্যে প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে এ রাতের কোন উল্লেখ নেই। বরং একাধিক হাদীসে এ রাতের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটু পরেই সেগুলোর আলোচনা আসবে। যেথায় এ রাতকে ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ বা ‘শাবানের ১৫তম রজনী’ নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে। তাই ‘শবে বরাত’ না বলে এ রাতকে “‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’” বলাই শ্রেয়। কারণ, এটিই হাদীসের দেয়া নাম।

তবে হ্যাঁ, বরাত বলতে যদি আরবী براءة (বারাআহ) কে বুঝানো হয়, তাহলে অনেকটা মেনে নেয়া যায়। যার অর্থ, মুক্তি বা দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি। তাহলে পুরো অর্থ দাঁড়াবে, গুনাহ বা জাহান্নাম থেকে মুক্তির রাত। কারণ হাদীসের আলোকে বুঝা যায়, এ রাতে এমনটি ঘটে থাকে।

শরীয়তের মানদন্ডে শাবানের ১৫তম রজনীর মাহাত্ম্য:

আরবি চান্দ্র মাসের শাবানের মধ্য রজনী একটি পবিত্র ও মাহাত্ম্যপূর্ণ রজনী। এর রয়েছে স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য। আল্লাহ তা‘আলার বিশেষ করুণা ধন্য এ রাত। এ রাতে ইবাদাত-বন্দেগী করা উত্তম। এ মর্মে কুরআনে কিছু না থাকলেও হাদীসের মধ্যে রয়েছে সুস্পষ্ট বক্তব্য। একাধিক হাদীস দ্বারা এই মর্যাদা সুপ্রতিষ্ঠিত। হযরত মু‘আয বিন জাবাল, আবু বকর, আবু ছা‘লাবাহ, আবু মুসা আশ‘আরী, আবু হুরায়রা, ‘আয়েশা, আবদুল্লাহ বিন ‘উমার ও আওফ বিন মালিক (রা.) প্রমুখ সাহাবী থেকে এ সব হাদীস বর্ণিত হয়েছে।
নিন্মে হাদীসগুলো সূত্র ও স্তর বিবরণসহ উল্লেখ করা হলো: ১. হযরত মু‘আয বিন জাবাল (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল (স.) ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তাঁর সমস্ত সৃষ্টির দিকে শাবানের মধ্যরাতে দৃষ্টি দেন। অতঃপর তাঁর সমস্ত সৃষ্টিকে মাফ করে দেন, শুধুমাত্র মুশরিক ও হিংসা-বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতীত”। ২. হযরত আবু বকর (রা.) থেকে বর্ণিত। তিনি বলেন, রাসূল (স.) বলেছেন, “যখন শাবানের মধ্য রাত আসে, আল্লাহ দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন। তারপর সব বান্দাকে মাফ করে দেন। শুধুমাত্র মুশরিক ও যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের প্রতি শত্রুতাভাবাপন্ন তাদেরকে ছাড়া”।
৩. ইমাম তিরমিযি হযরত ‘আইশা (রা.) থেকে বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, “একদা রাত্রিতে আমি রাসূল (স.) কে খুঁজে পাচ্ছিলাম না। তাই তার সন্ধানে বের হলাম। জান্নাতুল বাকীতে গিয়ে তাকে পেলাম। তিনি বললেন, তুমি কি আশঙ্কা করছিলে যে, আল্লাহ ও তাঁর রাসূল (স.) তোমার হক নষ্ট করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি ভেবেছিলাম, আপনি অপনার অন্য কোন স্ত্রীর কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তা‘আলা অর্ধ শাবানের রাত্রিতে দুনিয়ার আকাশে অবর্তীর্ণ হন এবং বনী কালবের ছাগল পালের লোমের চেয়ে অধিক পরিমাণ মানুষের গুনাহ মাফ করে দেন”। ইমাম তিরমিযী হাদীসটি বর্ণনা করে বলেন, ‘আইশার হাদীসটি হাজ্জাজের এই সূত্র ছাড়া অন্য কোন ধারা থেকে আমাদের জানা নেই। মুহাম্মাদ এই হাদীসটিকে দুর্বল বলেছেন বলে শুনেছি”। হাদীসটি আরো বর্ণনা করেছেন ইবনু মাজাহ, ইবনু আবি শাইবাহ, আহমাদ বিন হাম্বল। শুআইব আরনাউত বলেন, إسناده ضعيف এর সনদটি দুর্বল।

ইমাম ইবনু তাইমিয়্যাহ (র.) বলেন, “অর্ধ শাবানের রাতের মাহাত্ম্য রয়েছে। সালাফদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে নামায পড়াতেন। তবে মসজিদের মধ্যে এ রাতে ইবাদাতের জন্য একত্রিত হওয়াটা বিদ‘আত। অনুরূপ আলফিয়্যাহ নামক বিশেষ নামায আদায় করাও বিদ‘আত”।
তিনি আরো বলেন, “অর্ধ শাবানের রাত্রির ব্যাপারে অনেক হাদীস ও আছার বর্ণিত হয়েছে। যদ্বরা এ রাতের মাহাত্ম্য ও মর্যাদা প্রতিষ্ঠিত হয়। সালাফ বা পূর্বসুরীদের মধ্যে কেউ কেউ এ রাতে বিশেষ করে নামায আদায় করতেন। শাবান মাসের রোজার ব্যাপারে বিশুদ্ধ হাদীস এসেছে। তবে শুধুমাত্র পনেরতম দিবসে একটি রোজা পালন করার কোন মূলভিত্তি নেই। বরং তা মাকরূহ। তিনি আরো বলেন, তদ্রƒপ এটিকে রকমারী খাদ্য, হালুয়া তৈরি ও সাজ-সজ্জা প্রকাশের উপলক্ষ্য বানানো বিদ‘আত। যার কোন ভিত্তি নেই। আর এ রাতে রিযিক বন্টিত হয় এ মর্মে যা কিছু বলা হয় তা প্রমাণিত হয়নি”।

মুসলিম উম্মাহ’র এ রাতে করণীয় ও বর্জনীয় :
উল্লিখিত হাদীসগুলো দ্বারা এ রাতের মাহাত্ম্য প্রমাণিত হলেও সেগুলোতে এ রাতের করণীয় কী, তা স্পষ্ট করে বলা হয়নি। শুধুমাত্র হযরত ‘আইশার হাদীসে কিছু নমুনা পাওয়া যায়। তবে করণীয়ের চেয়ে এগুলোতে বর্জনীয় কাজের প্রতিই অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে। আর সে গুলো হচ্ছে:
১. শিরক করা; ২. অন্যদের প্রতি বিদ্বেষ পরায়ণ হওয়া; ৩. কাউকে হত্যা করা; ৪. আত্মীয়তার সম্পর্ক ছিন্ন করা; ৫.টাখনুর নীচে কাপড় পরা; ৬. মা-বাবার অবাধ্য হওয়া; ৭. মদ সেবন করা।
তাই এ রাত্রির মাহাত্ম্য অর্জন করতে হলে প্রথমেই এ সব কাজ থেকে নিজেকে পবিত্র করতে হবে। তাওবাহ ও পারস্পরিক সম্পর্ক সুসংহত করে নেয়ার মাধ্যমে। হিংসা-বিদ্বেষ, হানাহানির মনোভাব পরিত্যাগ করতে হবে।

এছাড়া ও যে কাজগুলো এ রাতে করা যেতে পারে, তাহলো-
ক. নফল নামায, জিকির-আজকার, তিলাওয়াত,ইলম চর্চা, দু‘আ ইত্যাদি। তবে তা একাকী করাই উত্তম। কিন্তু মনে রাখতে হবে, এ রাতের কোন নির্দিষ্ট নামায বা অন্যকোন নির্দিষ্ট ইবাদাত নেই। যেমনটি অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়। এ রাত উপলক্ষ্যে, জামাতের সাথে বিশেষ ধরনের নামায আদায় করা, কিংবা অনিবার্য মনে করে মিলাদ মাহফিল করা বা মিষ্টি-হালুয়া ইত্যাদি বিরতণ, কিংবা ভাগ্য রজনী মনে করে সারা বছর ভালো খাওয়া যাবে এ নিয়্যাতে এ রাতে রকমারী সুস্বাদু খাদ্য ব্যঞ্জনা খাওয়া, মসজিদ-মাজার ইত্যাদি আলোকসজ্জিত করা, ঈদ উৎসবের আমেজ নিয়ে আড়ম্বতাপূর্ণ পরিবেশে একত্রিত হওয়া, এ রাতকে লাইলাতুল কদরের সমপর্যায়ে নিয়ে প্রাপ্তির চেয়ে অধিক প্রদান করা এগুলো সবই হচ্ছে বাড়াবাড়ি।
পরের দিন রোজা রাখা যাবে কিনা?

ক. প্রথম কথা হলো, রাসূল (স.) শাবান মাসের বেশির ভাগই রোজা রাখতেন। যেমনটি নিচের হাদীসদ্বয় দ্বারা প্রমাণিত হয়। হযরত উসামাহ বিন যাইদ থেকে বর্ণিত। তিনি রাসূল স. কে জিজ্ঞেস করেছিলেন, “ইয়া রাসূলাল্লাহ, শাবান মাসে আপনি যে পরিমাণ রোজা রাখেন, আপনাকে অন্য কোন মাসে এত রোজা রাখতে দেখিনা। তখন রাসূল (স.) বললেন, রজব এবং রমাদানের মধ্যে অবস্থিত শাবান সম্পর্কে অধিকাংশ মানুষই উদাসীন। তাছাড়া, এ মাসে মানুষের আমলগুলো আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়, তাই আমি চাই রোজাদার অবস্থায় যেন আমার আমলগুলো আল্লাহর কাছে পেশ করা হয়”।

খ. হযরত আইশা থেকে বণিত, “রাসলূকে (স.) শাবান মাসের মত এত রোজা অন্য কোন মাসে রাখতে দেখিনি । তিনি পুরো শাবান কিংবা এর অধিকাংশ অংশই রোজা রাখতেন”। দ্বিতীয়ত: শুধু ১৫ই শাবান দিবসে একটি রোজা রাখা যাবে কিনা, এ ব্যাপারে একটি হাদীস রয়েছে। তবে হাদীসটি বিশুদ্ধ না হওয়ায় তা প্রমাণযেগ্য নয়।

যদি কেউ এ নিয়্যাত করে ১৫ শাবানের রোযা রাখে যে, এটি শাবান মাসের একটি দিনের রোযা কিংবা বেজোড় দিবসসমূহ অথবা তা সোম ও বৃহস্পতিবারের অভ্যাসগত রোযার সাথে মিলে যায়, তাতে কোন সমস্যা নেই। বরং এর মাধ্যমে সে সুন্নাতেরই অনুসরণ করলো। নিয়্যাতই এখানে পার্থক্য নির্ণয়কারী। রাসূল (স.) বলেন, “নিয়্যাতের উপরই নির্ভরশীল মানুষের আমল”। মোট কথা, এ রাতের মাহাত্ম্য আছে, তবে সীমালংঘনের সুযোগ নেই।

RELATED ARTICLES

Most Popular