নবদূত রিপোর্টঃ
অবহেলা আর অযত্নে প্রায় ৫ দশকেরও বেশি সময় ধরে পরিত্যক্ত লালমনিরহাট বিমানবন্দর। এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বিমানবন্দর এটি। এই বৃহত্তম বিমান বন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে ঘটবে অর্থনৈতিক বিপ্লব, উম্মোচন হবে যোগাযোগের এক নতুন দ্বার। পাল্টে যাবে উত্তরাঞ্চলের দৃশ্যপট। কবে বিমানবন্দর চালু হবে এই আশায় যুগ যুগ ধরে অপেক্ষায় ছিলেন ৩ জেলার মানুষ। অবশেষে ২০২১ সালে সমাজকল্যাণ মন্ত্রী নুরুজ্জামান আহমেদ এমপি ও বিমান বাহিনীর প্রধান বিমানবন্দরটি পরির্দশনের মধ্যেদিয়ে নতুন আশায় বুক বেধেছে লালমনিরহাটের মানুষ।
জানা গেছে, ১৯৩১ সালে তৎকালীন বৃটিশ সরকারের আমলে লালমনিরহাট সদর উপজেলার মহেন্দ্রনগর ও হারাটি এলাকায় ১ হাজার ১৬৬ একর জমি অধিগ্রহণ করে বিমানবন্দর নির্মাণ শুরু করে। ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থান থেকে রেলযোগে বড় বড় পাথর, বোল্ডার ও অন্যান্য সামগ্রী এনে দ্রুতগতিতে চলতে থাকে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে রানওয়ে ও অবকাঠামো নির্মাণকাজ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ চলাকালে এ বিমান বন্দরেই ছিল মিত্র বাহিনীর একমাত্র ভরসাস্থল। ১৯৪৫ সালে যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর নতুন করে ব্যবহার না হওয়ায় জৌলুস হারাতে থাকে এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম এ বিমানবন্দরটির।
তবে ১৯৫৮ সালে স্বল্প পরিসরে বিমান সার্ভিস চালু হলেও তা বেশিদিন আলোর মুখ দেখেনি। বিমান চলাচলে লোকসান হওয়ায় তা বন্ধ করে দেওয়া হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭২ সালে এটিকে বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর হেডকোয়ার্টার করার সিদ্ধান্ত হয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা আর বাস্তবায়িত হয়নি। এ কারণে ৪ কিলোমিটার রানওয়ে, বিশাল টারমাক, হ্যাংগার, ট্যাক্সিওয়ে এগুলো সবই এখন পত্যিক্ত।
১৯৮৩ সালে বিমানবাহিনী কর্তৃপক্ষ এখানে কৃষি প্রকল্প গ্রহণ করে। সরকারি মূল্যবান স্থাপনা জুড়ে মিলিটারি ফার্মের তত্ত্বাবধানে গড়ে তোলা হয়েছে গরুর খামার। সংরক্ষিত ভূমিতে চলছে কৃষি কাজ।
সূত্র মতে, লালমনিরহাটকে তখন বলা হতো ‘গেটওয়ে টু নর্থ-ইস্ট’ এবং ‘মাউথ অব আসাম’। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চল এবং তখনকার বিশাল প্রদেশ বৃহত্তম আসামে প্রবেশের একমাত্র পথ ছিল লালমনিরহাট। রেলপথে ‘লালমনিরহাট জংশন’ এবং বিমান পথে ‘লালমনিরহাট জাহাজ ঘাঁটি’। ভারত ভাগ না হলে লালমনিরহাট তার এই যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুত্বের জন্য আপন মহিমায় হয়ে উঠত ‘দ্বিতীয় কলকাতা’
২০১৯ সালের (১৩ মার্চ) বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার চিফ মার্শাল মাসিহুজ্জামান সেরনিয়াবাত লালমনিরহাট বিমানবন্দর পরিদর্শনে আসেন। এরপর বিমান বাহিনীর প্রকৌশলীদের সঙ্গে নিয়ে পুরো বিমানবন্দর ঘুরে দেখেন এবং এর সম্ভব্যতা যাচাই করেন। এরপর সেনাবাহিনী, বিমান বাহিনী ও সিভিল প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নিয়ে বিমানবন্দরে সভা করেন তিনি।
এ অঞ্চলের ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার ও আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে পরিত্যক্ত বিমানবন্দরটি প্রথমদিকে বিমান কারখানা হিসেবে চালু করার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। কারখানা করার পর যাত্রী পরিবহনের জন্য চালু হবে ফ্লাইট। অপরদিকে লালমনিরহাট বিমানবন্দরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অ্যাভিয়েশন অ্যান্ড অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছেন। দেশে এই প্রথম একটি এভিয়েশন ও অ্যারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ে এয়ারক্র্যাফট নির্মাণ, মেরামত, স্যাটেলাইট নির্মাণ, উৎক্ষেপণ, মহাকাশ গবেষণা প্রযুক্তির বিষয়ে গবেষণা করা হবে বলে জানা গেছে। বিমানবন্দরটি চালু হলে নেপাল, ভুটান ও ভারতের অন্তত ১৩টি অঙ্গরাজ্যের সব শ্রেণির মানুষ অনায়াসে কম খরচে বাংলাদেশে আসতে পারবেন। বাংলাদেশীরাও ভারত, নেপাল ও ভুটানে অল্প খরচে গিয়ে সব কাজ করতে পারবে।
বিমানবন্দর চালু হলে, উত্তরাঞ্চলের কোটি মানুষ শিক্ষা, চিকিৎসা নিতে ওই ৩টি দেশে যেতে পারবেন। ওই ৩ দেশের হাজারও শিক্ষার্থী ও ব্যবসায়ী বাংলাদেশে এসে তাদের কাজ সম্পাদন করতে পারবে। সেই সাথে লালমনিরহাটের বুড়িমারি স্থলবন্দর, কুড়িগ্রামের সোনাহাট স্থলবন্দর আরও গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। বিমানবন্দরটি ব্যবহার হলে ভারতের আকাশসীমা লঙ্ঘিত হবে এ ইস্যুতে এটি বন্ধ রয়েছে। একটি ত্রিপক্ষীয় চুক্তির মাধ্যমে এ সঙ্কট উত্তরণ সম্ভব বলেই জেলাবাসী প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ চায়।
লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সভাপতি শেখ আব্দুল হামিদ বাবু বলেন, এশিয়া মহাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম এই বিমানবন্দরটি চালুর উদ্যোগ নিলে ঘুরে যাবে অর্থনীতির চাকা। বিমানবন্দর চালু হলে রংপুর অঞ্চলের অর্থনৈতিক দ্বার থেকে শুরু করে কয়েকটি দেশের সঙ্গে শিক্ষা চিকিৎসার ব্যাপক প্রসার ঘটবে।
লালমনিরহাট চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিজের সিনিয়র সহ-সভাপতি মোড়ল হুমায়ন কবির বলেন, বিমানবন্দরটি চালু হলে রংপুর অঞ্চলে অর্থনৈতিক বিপ্লব ঘটবে। সুযোগ তৈরি হবে নতুন নতুন ব্যবসা-বাণিজ্যের। যোগাযোগের ক্ষেত্রেও এক নতুন দ্বার উন্মোচিত হবে। ভারতের সেভেন সিস্টার হিসেবে পরিচিত সাত রাজ্যসহ আশপাশের আরও কয়েকটি রাজ্য, নেপাল এবং ভুটানের সঙ্গে বাংলাদেশের উপ-আঞ্চলিক যোগাযোগ তৈরির একটা অন্যতম মাধ্যম হতে পারে লালমনিরহাট বিমানবন্দর।
লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসক আবু জাফর বলেন, এ বিমানবন্দরটি নিয়ে সরকারের বড় ধরনের পরিকল্পনা রয়েছে। বিশেষ করে বিমান মেরামত ও কারখানা তৈরিসহ বিমান চলাচলের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।