-বিলাল হোসেন মাহিনী
আমরা শিক্ষক সমাজ অনেক সময় শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের নানা ত্রুটি-বিচ্যুতির কথা বলে থাকি। তাদের এই ত্রুটিগুলোকে সামনে এনে এটা বুঝাতে চাই যে, আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার অধঃপতনের জন্য অভিভাবকদের উদাসীনতা ও শিক্ষার্থীদের বই ভিন্ন অন্য বিষয়ে মনোযোগ-ই দায়ী। কিন্তু বাস্তবতা হলো, সব দোষ নন্দঘোষ নয়। আমাদের জাতীয় শিক্ষাক্রমে তো কিছুটা অসঙ্গতি আছে, অধিকিন্তু পাঠদানের সাথে আমরা যারা জড়িত তাদেরও কিছু সমস্য আছে। হ্যাঁ, এটাও ঠিক যে শিক্ষকগণ তাদের জীবন-যাপনে রাষ্ট্রীয়, অর্থনৈতিক ও সমাজিক নিরাপত্তা থেকে যথেষ্ট বঞ্চিত। তবু শিক্ষাগুরু বলে কথা! হাজারও প্রতিবন্ধকতা সত্ত্বেও তাদের শিরদাড়ায় জাতির প্রাণ; উন্নতি সমৃদ্ধি, সবটাই। জাতীয় উন্নয়ন ত্বরান্বিত করার জন্য শিক্ষা খাতে ব্যাপক বিনিয়োগ অপরিহার্য। অথচ, আমাদের দেশে শিক্ষা খাতে রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ ক্রমাগত কমছে। অর্থনীতিবিদদের মতে, শিক্ষা খাতে বিনিয়োগ সবচেয়ে লাভজনক এবং নিরাপদ রাষ্ট্রীয় বিনিয়োগ। অর্থনীতিবিদ অ্যাডাম স্মিথ, ডেভিড রিকার্ডো এবং মার্শালের মতে, শিক্ষা এমন একটি খাত যার কাজ হলো দক্ষ জনশক্তি গড়ে তুলে পুঁজির সঞ্চালন ঘটানো।
আমাদের দেশে মুখস্ত বিদ্যার অনেক দাম। কিন্তু টেকনিক্যাল ও লজিক্যাল বিদ্যার কোন দাম নেই। কারন পাঠ্যসুচীকে এমন ভাবে গঠন করা হয়েছে গদবাধা মুখস্ত না করলে কোন ভাবেই ভাল ফলাফল করা সম্ভব নয়। দেখুন, বিদেশীরা আমাদের দেশে ঠিকাদারি নিয়ে সেতু, রেলসহ নানা অবকাঠামো গড়ে তুলছে, আর আমার ছেলেরা উক্ত নির্মানে কতটি পিলার, কত বস্তা সিমেন্ট ব্যয় হলো তা মুখস্ত করে বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি ও চাকুরির পরীক্ষায় পাশ করছে। মজার ব্যাপার হলো, বিশ্ব এখন আর এই পথে নেই। বিশ্ব এগিয়ে চলছে সাইন্টিফিক এবং যৌক্তিক দিক দিয়ে। সারা বিশ্বে এ বিষয়ে ব্রেইন যাদের শার্প তাদেরই জয়জয়কার। যেমন সফটওয়্যার খাতে লজিক্যাল নলেজ ছাড়া কোন ভাবেই উন্নয়ন সম্ভব নয়। আমাদের দেশে প্র্যাকটিক্যাল, লজিক্যাল , টেকনিক্যাল ও সাইনটিফিক বিকাশের উল্লেখযোগ্য কোন সুযোগ নাই। শুধু আছে মুখস্ত বিদ্যার বিকাশের সুযোগ। সেজন্য অকালেই ঝড়ে পরছে দেশের মেধাবী ছাত্ররা। তাই প্রয়োজন পাঠসুচিকে প্রাকটিক্যাল, লজিক্যাল, টেকনিক্যাল ও সাইনটিফিক বিষয়ে অধিকতর জোরদার করা। এই যে, এসএসসি’র পর ডিপ্লোমা; এটা ৪ বছর করার কী যুক্তি আছে? তারা ¯œাতক ডিগ্রীর মানও পাচ্ছে না, আবার ব্যয় হচ্ছে অতিরিক্ত সময়।
পাঠদানে সাধারণত যেসব ত্রুটি লক্ষ্য করা যায়:
শিক্ষকগণ অনেকেই বই দেখে পাঠদান করা, শিক্ষার্থীদের ‘তুই’ বলে সম্বোধন করা, সময়মত পাঠদান শেষ করতে না পারা, শিক্ষকের আঞ্চলিক ভাষার প্রয়োগ, অশালীন শব্দ বা অপ্রাসঙ্গিক ভাষা প্রয়োগ করা, চেয়ার/টেবিল/ বেঞ্চের ওপর বসে পাঠদান করা, বোর্ড ব্যবহার না করে পাঠদান কার্যক্রম পরিচালনা করা, নিজের রুচি, পোষাক ও ব্যক্তিত্ব সম্পর্কে সচেতন না থাকা, পাঠদানকালে ভুল তথ্য দেওয়া বা না জেনে ভুল উত্তর দেয়া, শিক্ষার্থীদের নাম না জেনে এই ছেলে, ঐ মেয়ে ইত্যাদি সম্বোধন করা, পাঠ অনুযায়ী প্রশিক্ষণ সহায়ক সামগ্রী যেমন চার্ট,মডেল,ম্যাপ ইত্যাদি ব্যবহার না করা, শ্রেণি কক্ষে ইচ্ছাকৃত দেরিতে প্রবেশ এবং নির্ধারিত সময়ের পূর্বে বের হয়ে আসা, শ্রেণীকক্ষে মোবাইলে কথা বলা বা মোবাইলে ডুবে থাকা ইত্যাদি।
শিক্ষার প্রকৃত লক্ষ্য অর্জনে শিক্ষক : শিক্ষককে প্রাকটিক্যাল হতে হবে। কৃষি, প্রযুক্তি, সাহিত্য-জীবন দর্শন, ধর্ম-নৈতিকতাসহ প্রতিটি বিষয়ে শিক্ষককে বাস্তবভিত্তিক শিখণ-শিক্ষণ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। ধর্ম শিক্ষার মূল লক্ষ্য হলো মানুষের মাঝে মানুষের গোলামি করার পরিবর্তে ¯্রষ্টার বিধানাবলি মেনে চলার প্রবণতা সৃষ্টি করা এবং মানবতার সেবা করার দক্ষতা ও যোগ্যতা অর্জন করা। সর্বোপরি নৈতিকতা ও সাম্য প্রতিষ্ঠা করা কিন্তু আজকের শিক্ষা ব্যবস্থার ভাবধারা এর সম্পূর্ণ বিপরীত। এ শিক্ষা ব্যবস্থা থেকে শিক্ষা লাভকারীরা জীবনের কোনো মহত লক্ষ্য অর্জন করেনা বরং ধর্মেও মহৎ গুনাবলী ও যোগ্যতাও অর্জন করতে পারেনা।
আর একটি বড় সমস্যা : শিক্ষকের অন্য পেশায় জড়িত থাকা
বর্তমানে শিক্ষকের শিক্ষকতা ছাড়াও অন্য পেশায় জড়িত থাকতে দেখা যায়। এ প্রসঙ্গে একজন সহকারী শিক্ষক ী বলেন, শিক্ষকদের যে বেতন ভাতা দেওয়া হয় তাতে অনেক শিক্ষক সংসারের খরচের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারে না। ফলে শিক্ষকরা অন্য পেশায় জড়িত হয়। আপনি জেনে অবাক হবেন, একজন মাস্টর্স ডিগ্রী হোল্ডার শিক্ষক বেতন পান মাত্র ১২ হাজার প্লাস। আর ঈদ/উৎসব ভাতা পান বেতনের চার ভাগের একভাগ। তো কীভাবে একজন শিক্ষক এই শিক্ষকতা দিয়ে সংসার চালাবেন। শিক্ষণ-শিখনকে অধিকতর ফলপ্রসূ করতে পাঠের আচরণিক উদ্দেশ্য ও শিখনফল সামনে রেখে পাঠদান করা কর্তব্য। এবং ঈপ্সিত শিখনফল শিক্ষার্থীদের মাঝে ফুটিয়ে তুলতে পারলে শিক্ষকের পাঠদান আশানুরূপ হচ্ছে বলে আশা করা যায়। সাথে সাথে শিক্ষককে অবশ্যই প্রাকটিক্যাল হতে হবে। একাডেমিক পরীক্ষায় শুধু এ প্লাস নয়, বরং জীবনের বাস্তব ক্ষেত্রে এ প্লাস প্রাপ্তির প্রতিযোগিতা থাকতে হবে।
শিক্ষকের দায়িত্ব ও কর্তব্য :
শিক্ষক শ্রেণীকক্ষের প্রাণ। তাকে ঘিরেই পঠন-পাঠন প্রক্রিয়া আবর্তিত হয়। তাই তার দায়িত্ব-কর্তব্যও অনেক। এসব দায়িত্বের কিছু ব্যক্তিগত, কিছু প্রতিষ্ঠান-প্রশাসন কেন্দ্রিক, কিছু শিক্ষার্থী কেন্দ্রিক এবং কিছু সহকর্মী কেন্দ্রিক। আমরা শিক্ষকের মৌলিক কিছু দায়িত্ব ও কর্তব্য এখানে তুলে ধরা হ’ল-
শিক্ষক সময়নিষ্ঠ হবেন, পেশাগত উন্নয়নের জন্য প্রশিক্ষণ নিবেন এবং গৃহীত প্রশিক্ষণ কাজে লাগিয়ে পাঠদান করবেন, শিক্ষা সংক্রান্ত আধুনিক কলাকৌশল যেমন আই.সি.টি. ইত্যাদিতে পারদর্শিতা অর্জন করবেন, মাল্টিমিডিয়া ক্লাস গ্রহণে দক্ষতা অর্জন করবেন, পাঠটিকা প্রণয়ন করবেন এবং তদনুসারে ক্লাস নিবেন, তিনি হবেন একজন পড়ুয়া। সব রকম জ্ঞান অর্জনে তিনি সদা সচেষ্ট থাকবেন। ক্লাস রুটিন অনুযায়ী সময় মত শ্রেণীকক্ষে হাযির হবেন এবং নির্ধারিত সময়ে শ্রেণীর কার্যক্রম শেষ করবেন। শিক্ষার্থীদের নাম হাযিরা করবেন। শিক্ষার্থীদের নাম, ঠিকানা ও মোবাইল নম্বর ডায়েরিতে লিখে নিবেন। পাঠ দানের বিষয় নিজ ডায়রীতে লিখে রাখবেন। যেন পাঠদান করতে গিয়ে কোথায় পড়া তা শিক্ষার্থীদের কাছে জিজ্ঞেস করতে না হয় এবং পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়াই পাঠদান করা না হয়। শিখনফল অর্জিত হচ্ছে কি-না তা মূল্যায়ন করবেন। পাঠ আয়ত্ব করার কৌশল শিখাবেন। শিক্ষার্থীদের কারও প্রতি বিদ্বেষ এবং কারও প্রতি পক্ষপাতিত্ব করবেন না। পরীক্ষার উত্তরপত্র যথাসময়ে মূল্যায়ন করে পরীক্ষার ফলাফল তৈরি করবেন। মূল্যায়নকালে তিনি নৈর্ব্যক্তিক থাকবেন। কাউকে কম এবং কাউকে বেশী নম্বর দিবেন না। পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার কৌশল শিখাবেন। শিক্ষার্থীদের প্রতি ইতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন, নেতিবাচক দৃষ্টিভঙ্গি পোষণ করবেন না।
শিক্ষকের মৌলিক দায়িত্ব ও কর্তব্য, শিশুর পাঠদান পদ্ধতি ও শিখনফল নির্ণয়ের ধারণা রাখা একজন শিক্ষকের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ নিবন্ধে উক্ত বিষয়ে যা কিছু আলোচনা করা হয়েছে মহান আল্লাহ যেন তার উত্তম দিকগুলো থেকে আমাদেরকে উপকৃত হওয়ার তাওফীক দেন।
লেখক : বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, যশোর। সাহিত্য সম্পাদক : বাংলাদেশ মফস্বল সাংবাদিক সোসাইটি, জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট।
bhmahini@gmail.com