বাংলা একাডেমি, একুশে, স্বাধীনতা পদকসহ অসংখ্য সম্মাননা ও খ্যাতিতে ভরপুর সুফিয়া কামালের জীবন। তিনি লিখেছেন, ‘আমার শৈশব, বাল্য,কৈশোরের বেলা,/ মৃত্তিকা মাতার বুকে করেছি যে খেলা’। তিনি লিখে গেছেন, ‘জন্ম আমার যায়নি বৃথা’। এই মহিয়সী নারীর জন্মবার্ষিকী আজ (২০ জুন)। নারীমুক্তি, গণতন্ত্র, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, ধর্মান্ধতা ও অসম্প্রদায়িকতার এক শাশ্বত নিদর্শন এই অকুতোভয় বীরযোদ্ধা ছিলেন তিনি। ২০ জুন ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে বাংলাদেশের বরিশাল জেলায় জন্মগ্রহণ করেন সুফিয়া কামাল।
মায়ের কোলে থাকতেই তাঁর পিতা নিরুদ্দেশ হন, এরপর মায়ের সাথে মামাবাড়িতেই তাঁর বেড়ে ওঠা। বরিশালের শায়েস্তাবাদের নবাব পরিবারে অবরোধবাসিনী হিসাবেই ছিল তাঁর জীবন। পরিবারের স্বদেশী আন্দোলনের চেতনায় তিনি বেশি অনুপ্রাণিত হয়েছিলেন। এই স্বদেশী আন্দোলনের চেতনাকে আঁকড়ে কবি বেগম সুফিয়া কামাল এর শৈশব আবর্তিত ছিলো বলে কবির দেশপ্রেম এতো গভীর এতো মধুর।
কবি জীবন থেকে জানা যায়, যখন ছয়-সাত বছর বয়স তখন তিনি ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্ সম্পাদিত মুসলিম সাহিত্য পত্রিকায় প্রকাশিত কাজী নজরুল ইসলাম এর ধারাবাহিক ‘হেনা’ উপন্যাস মায়ের সহযোগিতায় বানান করে করে পড়ে ফেলেছিলেন। উপন্যাসের কাহিনী না বুঝলেও এ রকম বহু বই, গল্প, কবিতা পড়ার কথা তিনি নিজের বয়ানে বলেছেন।
শৈশবে তিনি বর্ষা বিষয়ে কবিতা লিখেছেন। ছোটোবেলায় তিনি ভাইদের সাথে জুবলী স্কুলে প্যারীলাল মাস্টারমশাই এর কাছে বাল্যশিক্ষা পড়েছেন। মসজিদে গিয়ে ভাইদের সাথে সুর করে ‘আরবি কায়েদা বোগদাদি’ পড়েছেন।
মাত্র বারো বছর বয়সেই মামাতো ভাই নেহাল হোসেন এর সাথে তাঁর বিয়ে হয়। কবির নাম ছিল সুফিয়া খাতুন, বিয়ের পর স্বামীর নামানুসারে তাঁর নাম হলো ‘সুফিয়া এন হোসেন। স্বামীর ব্যবস্থাপনায় তাঁর প্রথম গল্প ‘সৈনিক বধূ’ প্রকাশিত হয়। বলা প্রয়োজন কবির সাহিত্যচর্চার প্রেরণা ছিলেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর, কাজী নজরুল ইসলাম, ও রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন। ১৯৩২ সালে স্বামী নেহাল হোসেনকে হারিয়ে মাত্র ২১ বছর বয়সে তিনি বিধবা হন। ১৯৩৯ সনে কবির হিতাকাঙ্ক্ষী এডভোকেট কামাল উদ্দিন খাঁনকে বিয়ে করে, বেগম সুফিয়া কামাল হিসাবে পরিচিতি পান। ১৯৭৭সাল অবধি তাঁদের দাম্পত্য জীবন কেটেছে। তাঁদের সংসারেই বাংলাদেশের আলোকিত নারী, নারীর অধিকার আদায়ে সংগ্রামী নেত্রী ও নারীজাগরণের আলোকবর্তিকা এডভোকেট সুলতানা কামালের জন্ম।
তিনি ৫২এর ভাষা আন্দোলন, ৬৮এর অসহযোগ আন্দোলন, ৬৯ এর গণঅভ্যূত্থান, ৭১এর মুক্তিযুদ্ধ এবং স্বাধীন বাংলাদেশের বিভিন্ন সংগ্রামসহ শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক আন্দোলন, এ নারী জাগরণের অগ্রদূত, এবং সাহিত্যচর্চা ইত্যাদি নিয়ে সুফিয়া কামাল এর জীবন একসূত্রে ছিল গাঁথা।
১৯৭১সালে মুক্তিযুদ্ধের সময় নিজের বাসায় বন্দী জীবন যাপন করেছেন। কিন্তু শুধু বসে থাকেননি, যুদ্ধকালের সেই বন্দী জীবনের যাতনা প্রতিদিন লিখে গেছেন একটি গোপন খাতায়। তাঁর এই স্মৃতিচারণের কথা ‘একাত্তরের ডায়েরি’ নামে প্রকাশিত হয়েছে।
কবির উল্লেখযোগ্য রচনাবলি- সাঁঝের মায়া, উদাত্ত পৃথিবী। বাংলাদেশের একজন প্রথিতযশা কবি, লেখিকা, নারীবাদী ও আধুনিক বাংলাদেশের নারী প্রগতি আন্দোলনের একজন পুরোধা ব্যক্তিত্ব।
১৯২৬ সালে তার প্রথম কবিতা ‘বাসন্তী’ সেসময়ের প্রভাবশালী সাময়িকী সওগাতে প্রকাশিত হয়। ১৯৩৭ সালে তাঁর গল্পের সংকলন কেয়ার কাঁটা প্রকাশিত হয়। ১৯৩৮ সালে তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ সাঁঝের মায়ার মুখবন্ধ লেখেন কাজী নজরুল ইসলাম।মুসলিম নারীদের সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে অংশগ্রহণকে উৎসাহিত করার জন্য বেগম রোকেয়ার প্রতিষ্ঠিত সংগঠন ‘আঞ্জুমানে খাওয়াতিনে ইসলামে’ রোকেয়ার সঙ্গে সুফিয়া কামালের পরিচয় হয়।তিনি কলকাতা কর্পোরেশন স্কুলে শিক্ষকতা শুরু করেন।
ভাষা আন্দোলনে তিনি নিজে সক্রিয়ভাবে অংশ নেন। ১৯৫৬ সালে শিশুদের সংগঠন কচিকাঁচার মেলা প্রতিষ্ঠা করেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মহিলা হোস্টেলকে ‘রোকেয়া হল’ নামকরণের দাবী জানান। ১৯৬১ সালে পাকিস্তান সরকার কর্তৃক রবীন্দ্রসঙ্গীত নিষিদ্ধের প্রতিবাদে সংগঠিত আন্দোলনে তিনি জড়িত ছিলেন। এই বছরে তিনি ছায়ানটের প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। ১৯৬৯ সালে মহিলা সংগ্রাম কমিটির সভাপতি নির্বাচিত হন, গণঅভ্যুত্থানে অংশ নেন, পাকিস্তান সরকার কর্তৃক ইতঃপূর্বে প্রদত্ত তমঘা-ই-ইমতিয়াজ পদক বর্জন করেন। ১৯৭০ সালে মহিলা পরিষদ প্রতিষ্ঠা করেন। ১৯৭১ সালের মার্চে অসহযোগ আন্দোলনে নারীদের মিছিলে নেতৃত্ব দেন।১৯৯০ সালে স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে শরিক হয়েছেন। মুক্তবুদ্ধির পক্ষে এবং সাম্প্রদায়িকতা ও মৌলবাদের বিপক্ষে আমৃত্যু তিনি সংগ্রাম করেছেন। প্রতিটি প্রগতিশীল আন্দোলনে অংশ নিয়েছেন।১৯৯৯ সালের ২০ নভেম্বর সুফিয়া কামাল মৃত্যুবরণ করেন। তাকে পূর্ণ রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় সমাহিত করা হয়। বাংলাদেশী নারীদের মধ্যে তিনিই প্রথম এই সম্মান লাভ করেন।
বিলাল মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর।