Wednesday, December 25, 2024
Homeধর্মমহাবিষ্ময় কিতাব আল-কুরআনের পরিচয়

মহাবিষ্ময় কিতাব আল-কুরআনের পরিচয়

বিলাল মাহিনী

পবিত্র কুরআন মানব জাতির জন্য আলোকবর্তিকা। এই কুরআন শুধুমাত্র একটি গ্রন্থাকারে লিখিত কিতাবই নয়, বরং এই কুরআনের ম্যাসেজগুলো মানুষের জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রের লাখো-কোটি সমস্যার সমাধান দিয়ে থাকে। পবিত্র কুরআন এক বিষ্ময়গ্রন্থ। যার তুলনা এই নশ্বর পৃথিবীতে বিরল। কেননা, পবিত্র কুরআন এমন একটি কিতাব, যে কিতার হাফেজ সংখ্যা কয়েক লক্ষ। যেটা পৃথিবীর অন্য কোনো ধর্মগ্রন্থের ক্ষেত্রে অসম্ভব। তাছাড়া পবিত্র কুরআন এমন একটি বিষ্ময় কিতাব যার সৃষ্টি তথা অবতরণ থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত একটি শব্দ তো দূরে থাক একটি নুকতা বা হরকতেরও পরিবর্তন ঘটেনি। এবং কেয়ামত পর্যন্ত কুরআনের মধ্যে কেউ কখনো পরিবর্তন-পরিবর্ধন করতে পারবে না। মহান আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এ এক মহিমান্বিত কুরআন, যা লাওহে মাহফুজে-সুরক্ষিত ফলকে সংরক্ষিত। (সূরা বুরুজ, আয়াত ২১-২২)

ইসলামী ঐতিহ্য অনুযায়ী, হেরা গুহায় অবস্থানকালে মুহাম্মাদ স. এর নিকট প্রথম কুরআনের বাণী প্রেরিত হয়। এরপর ২৩ বছর ধরে তাঁর নিকট কুরআনের বাণী প্রেরিত হয়। মুহাম্মাদ স. এর জীবদ্দশায় তাঁর তত্ত্বাবধানে প্রথম পূর্ণ কুরআন লিপিবদ্ধ হয়। কিন্তু এগুলো এক জায়গায় একত্রিত করা হয়নি তখন। প্রথম খলিফা হযরত আবু বকর এর যুগে দ্বাদশ হিজরি সালে ইয়ামামার যুদ্ধ সত্তর জন হাফেজে কুরআন শাহাদাত বরণ করেন। এতে হযরত ওমর রা. উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েন। তিনি খলিফা আবু বকর রা. কে বলেন, “এভাবে জিহাদে হাফেজগন শহীদ হতে থাকলে কুরআনের অনেক অংশ বিলুপ্ত হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। অতএব, আপনি কুরআন মাজিদ একত্রে সংকলনের ব্যবস্থা গ্রহণ করেন।”
এরপর খলিফা আবু বকর ওহি লেখক যায়িদ বিন সাবিতের নেতৃত্বে কুরআন সংকলন বোর্ড গঠন করেন। এবং পবিত্র কুরআন পূর্ণরূপে লিখিত হয়। এরপর তৃতীয় খলিফা হযরত ওসমান রা. এর আমলে পবিত্র কুরআনের সর্বশেষ সংকলন তৈরি হয়। এবং এখনো পর্যন্ত সারা দুনিয়ায় উক্ত কুরআনের অনুলিপি পঠিত হচ্ছে। পবিত্র কুরআনকে বিকৃতি ও বিভ্রান্তি থেকে রক্ষা করার জন্য হযরত ওসমান রা. কে জামেউল কুরআন বা কুরআন একত্রকারী বলা হয়।

পবিত্র কুরআনের নামকরণ সম্পর্কে আল্লামা আবুল মাআলী বলেন, কুরআনের মোট ৫৫টি নাম রয়েছে। অনেক বিষেজ্ঞের মতে, কুরআনের নাম ৯০টিরও বেশি। ইমাম জারকানি বলেন, কুরআনের মূল নাম ৫টি। আর বাকিগুলো হল গুণবাচক নাম। মানাহিল ইরফান ১/৮। পবিত্র কুরআনের মূল ৫টি নামের মধ্যে প্রধান নাম হলো কুরআন। আল্লামা জারকানী লেখেন, কুরআন শব্দটি কিরাআত থেকে এসেছে। অর্থ পঠিত, পড়া, পাঠ করা। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমরা যখন কুরআন পড়ি-পাঠ করি, তখন তুমি সে পড়া-পাঠের অনুসরণ করো।’ (সূরা কিয়ামাহ, আয়াত ১৮)
পবিত্র কুরআন এমন একটি গ্রন্থ, যা বিশ্বব্যাপী সবচেয়ে বেশি পঠিত বা পড়া হয়। তাই কুরআনকে কুরআন নামকরণ করা হয়েছে। অথবা কুরআন এমন এক গ্রন্থ, যা মানুষের কল্যান-মুক্তি ও ইহ-পরলোকে শান্তির জন্য অবশ্যই পড়তে হবে, বুঝতে হবে, জানতে হবে এবং বাস্তবায়ন করতে হবে। তাই কুরআনের নাম কুরআন রাখা হয়েছে। লিসানুল আরব, ১/১২৪; মু’জামুল ওয়াসীত, পৃ. ৭২২।
আরবি ভাষাবিদ আল্লামা রাগেব ইসপাহানী রহ. বলেন, কুরআন শব্দটি এসেছে ‘কারনুন’ থেকে। যার অর্থ হলো- মেলানো, একত্রিত, সংযুক্ত। কুরআনের এক আয়াত অপর আয়াতের সঙ্গে, এক সূরা আরেক সূরার সঙ্গে, এক অংশ অন্য অংশের সঙ্গে মেলানো এবং সংযুক্ত। তাই এ নামে কুরআনের নামকরণ করা হয়েছে। শরহে নুরুল আনওয়ার, পৃ. ৮৪। এছাড়াও পবিত্র কুরআনের প্রসিদ্ধ কয়েকটি নাম হলো- আল-ফুরকান (সত্য-মিথ্যার পার্থক্যকারী), জিকির (স্মরণ), কিতাব (লিখিত গ্রন্থ), তানজিল (অবতীর্ণ)।
পবিত্র কুরআনকে যদি প্রশ্ন করা হয় তুমি কখন এই ধরাতে এসেছো? মহান আল্লাহ তায়ালা কুরআনের মাধ্যমে জানান, ‘রমজান মাস হলো সেই মাস, যে মাসে নাজিল করা হয়েছে কোরআন।’ (সূরা বাকারাহ, আয়াত ১৮৫) কুরআনের ভাষা কী? আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘এ কোরআন আমি আরবি ভাষায় নাজিল করেছি, যাতে তোমরা সহজে বুঝতে পারো।’ (সূরা ইউসুফ, আয়াত ২)
পবিত্র কুরআন আল্লাহ তায়ালার কিতাব। তিনি যুগে যুগে মানবতার হেদায়েতের জন্য যেসব কিতাব অবতীর্ণ করেছেন সেগুলোকে আসমানি কিতাব বলা হয়। কুরআনে কারিম হলো সর্বশেষ আসমানি কিতাব, যা বিশ্বমানবতার জন্য অবতীর্ণ করা হয়েছে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘নিশ্চয় এ কুরআন বিশ্ব জাহানের রবের পক্ষ থেকে অবতীর্ণ করা হয়েছে।’ (সুরা আশ শুয়ারা : ১৯২)
ইমাম খাত্তাবি রহ. বলেন, হাদিসে এসেছে, জান্নাতের সিঁড়ির সংখ্যা হচ্ছে কুরআনে কারিমের আয়াতের সংখ্যা পরিমাণ। কুরআনের পাঠককে বলা হবে, তুমি যতটুকু কুরআন পড়েছো ততটি সিঁড়ি বেয়ে ওপরে ওঠো। যে ব্যক্তি সম্পূর্ণ কুরআন পড়েছে, সে আখেরাতে জান্নাতের সবশেষ সিঁড়ির ধাপে উঠে যাবে। যে ব্যক্তি কুরআনের কিছু অংশ পড়েছে সে ততটুকু ওপরে উঠবে। অর্থাৎ যেখানে তার পড়া শেষ হবে সেখানে তার সওয়ারের শেষ সীমানা হবে।

পবিত্র কুরআনের বৈশিষ্ট্য, মহত্ম ও মাহাত্ত্ব :
পবিত্র কুরআন একটি নির্ভুল গ্রন্থ । মহাগ্রন্থ আল কুরআনের একটি গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য হচ্ছে এটি একটি নির্ভুল কিতাব যার ভেতরে কোনো প্রকার সন্দেহ-সংশয়ের অবকাশ নেই। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘(কুরআন) সেই কিতাব, যাতে কোনো সন্দেহ নেই, এতে রয়েছে মুত্তাকিদের জন্য পথের দিশা।’ (সুরা আল বাকারা : ২)
পবিত্র কুরআন হলো নূর (আলো)। অন্ধকারে নিমজ্জিত জাতিকে সত্যিকারের আলোর দিকে নিয়ে আসার জন্য আল কুরআন হলো আলো বা নূর। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘অবশ্যই তোমাদের কাছে আল্লাহর পক্ষ থেকে আলো ও সুস্পষ্ট গ্রন্থ এসেছে। এর মাধ্যমে আল্লাহ তাদের শান্তির পথ দেখান, যারা তার সন্তুষ্টির অনুসরণ করে এবং তার অনুমতিতে তিনি তাদের অন্ধকার থেকে আলোর দিকে বের করেন। আর তাদের সরল পথের দিকে হেদায়েত দেন।’ (সুরা মায়িদা : ১৫-১৬)
কুরআন সংরক্ষণের দায়িত্ব মহান রব আল্লাহর। কুরআন যাবতীয় বিকৃতি থেকে মুক্ত। কেননা আল্লাহ তায়ালা এর সংরক্ষণ করবেন। কুরআনে কারিমে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয় আমি উপদেশবাণী তথা কুরআন নাজিল করেছি এবং নিঃসন্দেহে এর হেফাজতকারী আমি নিজেই।’ (সুরা আল হিজর : ৯)
পবিত্র কুরআন মানবজাতির জন্য হেদায়েত। আমাদের ব্যক্তিগত, পারিবারিক, সামাজিক এবং রাষ্ট্রীয় জীবন কীভাবে পরিচালিত হবে, তার প্রতিটি বিষয় কুরআনে বর্ণনা করা হয়েছে। এ বিষয়ে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আমি তোমার কাছে কিতাবটি নাজিল করেছি। এটি এমন যে তা সবকিছুর সুস্পষ্ট বর্ণনা, আর এটা হেদায়েত, রহমত ও মুসলিমদের জন্য সুসংবাদস্বরূপ।’ (সুরা আন নাহল : ৮৯)
মানুষের জন্য রহমত আল-কুরআন। পবিত্র কুরআন মজিদ বিশ্ববাসীর জন্য রহমত হিসেবে নাজিল করা হয়েছে। যারা এ কুরআন পড়বে, সে অনুযায়ী আমল করবে তারা আল্লাহর রহমতপ্রাপ্ত হবে। আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আর আমি কুরআন নাজিল করি যা মুমিনদের জন্য শেফা ও রহমত, কিন্তু তা জালিমদের ক্ষতিই বাড়িয়ে দেয়।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৮২)

পবিত্র কুরআন জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস। কুরআন মজিদ সব জ্ঞান-বিজ্ঞানের উৎস এবং কোরআন যে নির্দেশনা দিয়েছে তা নির্ভুল ও বাস্তবভাবে প্রমাণিত হয়েছে। কুরআনে কারিমে ইরশাদ হচ্ছে, ‘ইয়াসিন। বিজ্ঞানময় কোরআনের শপথ।’ (সুরা ইয়াসিন : ১-২)
বিশ্ববাসীর জন্য চ্যালেঞ্জ এই কিতাব। কুরআনের মতো কোনো কিতাব মানুষ বা কারও পক্ষে বানানো সম্ভব নয়। প্রায় চৌদ্দশত বছর আগের চ্যালেঞ্জ এ পর্যন্ত কেউ মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়নি, কিয়ামত পর্যন্ত তা সম্ভবও হবে না। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘বলো, যদি মানব ও জিন জাতি সবাই মিলে একত্রিত হয় যে, তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছু আনয়ন করবে, তারা এ কুরআনের অনুরূপ কিছুই আনয়ন করতে পারবে না, যদিও তারা একে অপরের সাহায্যকারী হয়।’ (সুরা বনি ইসরাইল : ৮৮)

কুরআন শিক্ষার প্রতিদান জান্নাত। নবী কারিম সা. বলেন, যে ব্যক্তি কুরআন পাঠ করবে, শিক্ষা করবে ও তদনুযায়ী আমল করবে; তার পিতা-মাতাকে দুটি পোশাক পরিধান করানো হবে, যা দুনিয়ার সব বস্তুর চেয়ে অধিক মূল্যবান। তারা বলবে, কোন আমলের কারণে আমাদের এত মূল্যবান পোশাক পরানো হয়েছে? বলা হবে, তোমাদের সন্তানের কুরআন গ্রহণ করার কারণে। (মুসতাদরাকে হাকেম)
একটি কিতাব যে মানুষকে সোনার মানুষে পরিণত করতে পারে তার দৃষ্টান্ত হলো আল-কুরআন। যে নূরের স্পর্শে মরু আরবের আব্দুল্লাহ’র পুত্র মুহাম্মদ স. বিশ্বসেরা মানুষ হিসেবে পরিগণিত হলেন। আজ চৌদ্দশত বছর পর কে চিনতো আবু বকর, ওমর, ওসমান ও আলী রা.কে? পবিত্র কুরআনের সংস্পর্শে মাটির মানুষগুলো সোনার মানুষে পরিণত হলো।

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর । যুগ্ম সম্পাদক- ভৈরব-চিত্রা রিপোর্টার্স ইউনিটি। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট। কাজের ক্ষেত্র : কবিতা, প্রবন্ধ-নিবন্ধ, সাহিত্য-সংস্কৃতি শিক্ষকতা ও সাংবাদিকতা।
bhmahini@gmail.com

RELATED ARTICLES

Most Popular