আইএমএফের কাছ থেকে ঋণ পাবার জন্য সংস্থাটির সাথে বাংলাদেশ সরকারের সমঝোতা হয়েছে। আগামী তিন মাসের মধ্যেই এই ঋণের সব আনুষ্ঠানিকতা চূড়ান্ত করবে সংস্থাটি।
মোট সাত কিস্তিতে তারা বাংলাদেশকে সাড়ে চার বিলিয়ন ডলার ঋণ দেবে। এ ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে সুদ হার নির্ধারিত হবে বাজারদর অনুযায়ী, যা গড়ে দুই দশমিক দুই শতাংশ হবে।
তবে আইএমএফ বলেছে দেশের সামষ্টিক অর্থনৈতিক স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনা এবং এ ক্ষেত্রে যেসব বাধা আছে সেগুলো ঠেকাতেই এ ঋণ দেয়ার বিষয়ে সমঝোতা হয়েছে।
সংস্থাটি তাদের বিজ্ঞপ্তিতে ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্তের কারণ উল্লেখ করে বলেছে যে করোনা মহামারির পর বাংলাদেশ অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধারে অগ্রসর হচ্ছিলো কিন্তু যুদ্ধের কারণে সেটি বাধাগ্রস্ত হয়েছে। এর ফলে বিদেশী মুদ্রার রিজার্ভ কমেছে, মূল্যস্ফীতির হার বেড়েছে এবং প্রবৃদ্ধির গতি কমেছে।
অর্থনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখন সমঝোতা অনুযায়ী বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার কার্যক্রম সরকারকে বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে আইএমএফ এর মতো সংস্থার ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বস্তি দেবে বলেই মনে করছেন তারা।
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ সরকারের অনুরোধে আইএমএফের একটি প্রতিনিধিদল গত ২৬শে অক্টোবর ঢাকায় আসে। তারা নয়ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশে অবস্থান করে কেন্দ্রীয় ব্যাংক, আন্ত:মন্ত্রণালয়সহ বিভিন্ন সংস্থার সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে তারা।
এরপর বুধবার বাংলাদেশ সরকারের সাথে সমঝোতার বিষয়টি জানিয়ে আনুষ্ঠানিক বিবৃতি দেয়। গত জুলাই মাসে প্রথম ঋণ চেয়ে আইএমএফকে চিঠি দিয়েছিলো সরকার।
আইএমএফ কি প্রত্যাশা করছে ও ঋণ শোধ করতে না পারলে কী হয়
আইএমএফ সাধারণত তার সদস্য দেশগুলোর মধ্যে কেউ অর্থনৈতিক কোন বিষয়ে সমস্যায় পড়লে বা প্রয়োজন বোধ করলে সহায়তার জন্য পাশে দাঁড়ায়।
সংস্থাটি যখন কোনো দেশের সাথে সমঝোতা করে সেখানে কিছু পলিসি প্যাকেজ থাকে যতে ঋণগ্রহীতা দেশ তার সংকট মোকাবেলা করতে পারে আবার একই সাথে দেশটি তার ঋণ শোধেরও যেন সক্ষমতা অর্জন করতে পারে।
অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর আন্তর্জাতিক এই সংস্থাটিতে কাজ করেছেন। মিস্টার মনসুর বিবিসি বাংলাকে বলছেন যে বাংলাদেশ একটি সংকটে পড়তে পারে বলে আশঙ্কা রয়েছে এবং সম্ভাব্য এই সংকট মোকাবেলা করতে আগে থেকেই এমন একটি কর্মসূচি দরকার ছিলো।
“কিন্তু মনে রাখতে হবে প্যাকেজটি সরকারের এবং সরকারই বাস্তবায়ন করবে। আইএমএফ শুধু দেখাশোনা করবে যে ঠিকমতো কাজটি হচ্ছে কি-না,” বলছিলেন মিস্টার মনসুর।
কোনো কারণে সরকার টাকা নিয়ে সঠিকভাবে ব্যবহার করতে না পারলে বা যেসব উদ্দেশ্যে টাকা দেয়া হয়েছে সেগুলো বাস্তবায়ন করতে না পারলে সংস্থাটি টাকা দেয়া বন্ধ করে দিতে পারে।
“এজন্যই ছয় মাস পর পর তারা পর্যালোচনা করে দেখবে বাংলাদেশ সংস্কার কর্মসূচি ঠিক মতো বাস্তবায়ন করতে পারছে কি-না এবং করলে তার ফলে দেশের অর্থনীতির উন্নতি হচ্ছে কি-না। প্রতিবার পর্যালোচনা করেই তারা কিস্তির টাকা ছাড় দেবে”।
ঋণ দেয়ার প্রক্রিয়া, আইএমএফ কী বলেছে ও সরকার কী বলছে
সরকার ও আইএমএফ এর মধ্যে ঋণ দেয়া নিয়ে যে সমঝোতা হয়েছে সেটি মূলত একটি প্রাথমিক সমঝোতা এবং এটি হয়েছে বাংলাদেশ সরকারের সাথে সংস্থাটির কর্মকর্তা পর্যায়ে। এরপর এটি ব্যবস্থাপনা পর্যায়ে অনুমোদনের পর আইএমএফ -র বোর্ডে পরিচালক পর্যায়ে উপস্থাপন করা হবে।
এর মানে হলো চূড়ান্ত অনুমোদনের জন্য এখনো আরও দুটি ধাপের আনুষ্ঠানিকতা বাকী আছে। তবে এর আগে বাংলাদেশ সরকারকে পরিচালক পর্যায়ে অনুমোদনের জন্য একটি অভিপ্রায় পত্র বা লেটার অব ইনটেন্ট দিতে হবে।
এর খসড়াটা অবশ্য আইএমএফ এর কাছ থেকেই আসবে এবং সেটাই বাংলাদেশ সরকার স্বাক্ষর করে আবার আইএমএফকে পাঠাবে।
অর্থনীতিবিদ দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন ঋণের টাকা বাংলাদেশ কিভাবে ব্যবহার করবে সেটি বিস্তারিত ভাবে সব বলা থাকবে এবং সময়সূচী ও লক্ষ্যমাত্রাগুলো সেখানে উল্লেখ থাকবে।
অর্থাৎ রাজস্ব ব্যয় বাড়ানো, ব্যাংকিং খাতের সংস্কার, বিনিয়োগ বাড়ানো কিংবা ভর্তুকি কমানোর মতো যেসব শর্ত আইএমএফ দিয়েছে সেখানে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হবে।
“টাকা দেয়ার আগে এটিই ঋণদাতাকে আশ্বস্ত করতে হবে যে সরকার সংস্কারে রাজি হয়েছে। এছাড়া প্রতিটি কিস্তি পাওয়ার জন্য আগেই সরকারকে অগ্রগতিগুলোও জানাতে হবে,” বলছিলেন মিস্টার ভট্টাচার্য।
ফলে সুনির্দিষ্টভাবে কী কী কর্মসূচি কীভাবে বাস্তবায়ন হবে সে সম্পর্কে একটি প্রতিশ্রুতিপত্র সরকারকে দিতে হবে।
বিশ্লেষকরা বলছেন আইএমএফ এর শর্ত মেনে এখন সরকারকে বাজেট ঘাটতি ধারণযোগ্য পর্যায়ে রাখতে হবে। মুদ্রা বিনিময় আরও নমনীয় করতে হবে।
যদিও বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী আ হ ম মোস্তফা কামাল বুধবার সংবাদ সম্মেলন করে বলেছেন যে সরকার সবসময়ই বাজেট ঘাটতি পাঁচ শতাংশের মধ্যে রাখার চেষ্টা করে আসছে। যদিও গত বছর ও চলতি অর্থ বছরে বাজেট ঘাটতি পাঁচ শতাংশেরও বেশি।
এছাড়া সরকারকে আর্থিক খাতের সংস্কারে কয়েকটি নতুন আইন করার পাশাপাশি পুরনো কয়েকটি আইন সংশোধন করতে হবে। আর রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে এবং এ জন্য রাজস্ব ব্যবস্থার সংস্কার ও কর প্রশাসনের দক্ষতা বাড়াতে হবে।
এ বিষয়েও আগেই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে জানিয়ে অর্থমন্ত্রী বলেছেন আগামী পাঁচ বছরে ভ্যাট আদায়ের জন্য প্রায় তিন লাখ ইএফডি মেশিন স্থাপন করা হবে।
আর জ্বালানি তেলে ভর্তুকি কমাতে হবে এবং মূল্য সমন্বয়ের ব্যবস্থাটি আন্তর্জাতিক বাজারের মূল্যের সাথে সমন্বয় করতে হবে।
প্রসঙ্গত, সরকার ইতোমধ্যেই জ্বালানি তেলের মূল্য অনেকখানি বাড়িয়ে দাম সমন্বয় করেছে এবং সামনেও আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বাড়লে বা কমলে তা সমন্বয় করা হবে।
এছাড়া ডলারের সাথে টাকার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে এবং এটিও সরকার শুরু করেছে বলে দাবি করেছেন অর্থমন্ত্রী।
আহসান এইচ মনসুর বলছেন বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির তালিকায় থাকা দেশ এবং সে কারণে প্রথমবারের মতো আইএমএফ জলবায়ু তহবিল থেকে বড় মাপের অর্থ দিতে যাচ্ছে বাংলাদেশকে।
ফলে জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবেলায় বাংলাদেশকে বেশ কিছু প্রকল্প ও কর্মসূচি নিয়ে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
কিন্তু সরকার কীভাবে শর্তগুলো বাস্তবায়ন করবে
বিশ্লেষকরা বলছেন সরকার এখন মূলত করের হার না বাড়িয়ে করের আওতা বাড়াবে। আর জ্বালানির মতো যেসব খাতে ভর্তুকি বেশি দেয়া হয় সেটা কমিয়ে আনার উদ্যোগ নেবে। একই সাথে ডলারের সাথে টাকার বিনিময়হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিতে হবে বলে মনে করছেন তারা।
অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত বলছেন আইএমএফের ঋণ হবে ব্যালেন্স অফ পেমেন্টের ক্ষেত্রে একটি সাপোর্ট এবং এসব প্রক্রিয়া তার মতে সরকার আগেই শুরু করেছে।
তার মতে ভর্তুকি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো পছন্দ করে না, যদিও উন্নত দেশগুলো জনস্বার্থে এ ধরণের ভর্তুকি দিয়ে থাকে । বাংলাদেশেও সরকারও সক্ষমতার বাইরে গেলে এটি নিয়ন্ত্রণ করে যেটা জ্বালানির ক্ষেত্রে সরকার করেছে।
এছাড়া টাকার বিনিময় হারের ক্ষেত্রেও সরকারকে বাজারমুখী হতে হবে। আর রাজস্ব বাড়ানো কোনো চাপের বিষয় নয় উল্লেখ করে মিস্টার বখত বলেন, সব সরকারই সবসময় চেষ্টা করেছে রাজস্ব বাড়াতে।
“পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা দেখলে বোঝা যায় যে সরকার এ বিষয়ে আগেই সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু বাস্তবায়ন পর্যায়ে সমস্যা হয়েছে। সরকার এখন সেটি নিরসন চেষ্টা করবে। এজন্য করের আওতা বাড়াবে হয়তো সরকার,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন তিনি।
বাংলাদেশের অর্থনীতিতে প্রভাব কেমন হবে
সাম্প্রতিক সময়ে ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে দেশে দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে এবং বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ কমে ৩৪ বিলিয়ন ডলারে এসেছে। প্রকৃত রিজার্ভ আরও আট বিলিয়ন ডলার কম বলে বলা হচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকেই।
অন্যদিকে রপ্তানি আয় কমেছে এবং ডলারের দাম বেড়ে গেছে। পাশাপাশি দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকা শক্তি রেমিট্যান্স আসাও কমে গেছে।
এখন আইএমএফ এর এ সিদ্ধান্তের ফলে ‘প্যানিক সিচুয়েশন’ যেটা তৈরি হয়েছিলো – সেটা কেটে যাবে বলে আশা করছেন অর্থনীতিবিদ জায়েদ বখত।
একই সাথে আন্তর্জাতিক এ সংস্থাটির ঋণ দেয়ার সিদ্ধান্ত আন্তর্জাতিক অন্য সংস্থাগুলোর সাথে কাজ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশকে স্বস্তি দেবে বলেও মনে করেন তিনি।
“আন্তর্জাতিক অঙ্গনে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি উজ্জ্বল হবে যা কোনো সংকটের আশঙ্কা থাকলেও সেটি মোকাবেলায় পদক্ষেপ গ্রহণে সহায়তা করবে,” বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন মিস্টার বখত।
তবে দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলছেন সরকার সংস্কার কর্মসূচি ঠিক মতো বাস্তবায়ন করলে স্বল্পমেয়াদে কিছু অসুবিধা তৈরি হতে পারে। যেমন টাকার অবমূল্যায়ন হলে মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে কিন্তু সুদের হার বাজারের ওপর ছেড়ে দিলে ব্যাংক থেকে ঋণ গ্রহণের প্রবণতা কমে আসবে।
ফলে ব্যাংক তারল্য সংকট কমবে এবং মূল্যস্ফীতির ওপর এর প্রভাব পড়তেও পারে। তিনি বলেন সরকারের উচিত ছিলো এসব পদক্ষেপ আগেই নেয়া।