Friday, November 15, 2024
Homeআন্তর্জাতিক১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র : ঐতিহাসিক দলিল

১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র : ঐতিহাসিক দলিল

১৯৭১ সালের ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকারের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠানে বক্তব্য রাখছেন অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম। ছবি: সংগৃহীত নবদূত নিউজ চ্যানেল


বিলাল হোসেন মাহিনী

মহান স্বাধীনতা বাঙালি জাতির সর্বশ্রেষ্ঠ অর্জন। আর ১০ এপ্রিল স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র একটি ঐতিহাসিক দলিল। এই দিনে মুজিবনগরে অস্থায়ী সরকার গঠন ও স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র প্রস্তুত করা হয়। বিশ্বদরবারে এই ঘোষণাপত্র ঐতিহাসিক ও অনন্য দলিল হিসেবে সমাদৃত। উক্ত ঘোষণাপত্রে মুক্তিযুদ্ধের ৩টি মূলনীতি প্রণীত হয়। তা হলো- সাম্য, মানবিক মূল্যবোধ ও সামাজিক ন্যায়বিচার। মূলত: এই তিন মূলনীতির ভিত্তিতে মহান মুক্তিযুদ্ধ সংঘটিত হয়। কিন্তু নতুন প্রজন্মের অনেকেই এই মূল তিন নীতি সম্পর্কে অবগত নন।

স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের প্রেক্ষাপট :
মার্চে ঢাকায় পাকিস্তান পার্লামেন্টারি পার্টির নেতা ও আওয়ামী লীগের প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সমঝোতা নাটক ব্যর্থ হওয়ার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ২৫ মার্চ রাতে গোপনে ঢাকা ত্যাগ করেন। ঐ কালরাতে পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক আইন প্রশাসক ও কোর কমান্ডার লে. জেনারেল টিক্কা খানের নির্দেশে জেনারেল রাও ফরমান আলীর নেতৃত্বে ঢাকায় এবং জেনারেল খাদিমের নেতৃত্বে অন্য ১০টি শহরে রাত ১১টা ৩০ মিনিটে শুরু হয়ে যায় পাকিস্তানি সামরিক জান্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞ। ’৭১-এর ২৬ মার্চ ১২টা ২০ মিনিটে (প্রথম প্রহর) পাকিস্তান পার্লামেন্টের মেজরিটি পার্টির নেতা আওয়ামী লীগের প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। “ইহাই হয়তো আমার শেষ বার্তা, আজ হইতে বাংলাদেশ স্বাধীন …….সর্বশক্তি দিয়ে হানাদার বাহিনীকে প্রতিরোধ করো …….. (অনূদিত)”- শেখ মুজিবুর রহমান। এরপর রাত ১টা ৩০ মিনিটে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে ধানমন্ডির ৩২ নম্বর বাসভবন থেকে গ্রেফতার করে ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে নিয়ে যাওয়া হয়।

এরপর ২ এপ্রিল ভোরে একটি সামরিক কার্গো বিমানে তাজউদ্দীন আহমদ, ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম, বিএসএফের ডিজি ও আঞ্চলিক প্রধান গোলক মজুমদার দিল্লির উদ্দেশে কলকাতা বিমানবন্দর ত্যাগ করেন। ৪ এপ্রিল তাজউদ্দিন আহমেদ ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে সৌজন্য সাক্ষাৎ করেন। তিনি জানতে চান, ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব? ইজ হি অল রাইট?’ জবাবে তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, বঙ্গবন্ধু আমাদের দায়িত্ব দিয়ে পাঠিয়েছেন। তিনি তার স্থান থেকে আমাদের নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। আমাদের বিশ্বাস, তিনি আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে যাচ্ছেন’ (সূত্র:মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি, লেখক:ব্যারিস্টার আমির-উল ইসলাম)। অত:পর, উভয়ে প্রবাসী সরকার গঠনের বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছান।

১০ এপ্রিল স্বাধীন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠিত হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে বলা হয়, ‘বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণকর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থে, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থে সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্ররূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ’৭১-এর ২৬ মার্চ ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।’ যাহা বিশ্বের ইতিহাসে আজও অনন্য দৃষ্টান্ত হিসেবে চির অম্লান হয়ে আছে।

উল্লেখিত বিশেষ অধিবেশনে, ’৭০ সালে জাতীয় পরিষদে নির্বাচিত মোট ১৬৭ সদস্য এবং প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত মোট ২৯৮ সদস্যের সমন্বয়ে গণপরিষদ গঠন করা হয়। উক্ত সংবিধান উপস্থিত ৪০৪ গণপরিষদ সদস্য কর্তৃক স্বাক্ষরিত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে রাষ্ট্রপতি, সৈয়দ নজরুল ইসলামকে উপরাষ্ট্রপতি এবং তাজউদ্দীন আহমদকে প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত করা হয়। এম মনসুর আলী অর্থমন্ত্রী, খন্দকার মোশতাক আহমেদ পররাষ্ট্রমন্ত্রী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব অর্পণ করা হয়।
এরপর ১৭ এপ্রিল মেহেরপুরের বৈদ্যনাথতলার আ¤্রকাননে দেশি-বিদেশি সাংবাদিকদের উপস্থিতিতে মন্ত্রিসভার শপথগ্রহণ অনুষ্ঠিত হয়, যা ‘মুজিবনগর সরকার’ হিসেবে পরিচিতি পায়। গণপরিষদের চিফ হুইপ ইউসুফ আলী ‘প্রক্লেমেশন অব ইনডিপেনডেন্স’ (স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র) পাঠ করেন। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি বাংলাদেশের প্রথম অন্তর্বতীকালীন সংবিধান ও স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র প্রক্রিয়ায় আইনি দলিল হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।

এম এ জি ওসমানীকে সশস্ত্র বাহিনীর অধিনায়ক এবং এম এ রবকে চিফ অব আর্মি স্টাফ নিয়োগ দেওয়া হয়। সমগ্র বাংলাদেশকে ১১টি সেক্টরে বিভক্ত করা হয় এবং ১১ জন সেক্টর কমান্ডার নিয়োজিত হন যথাক্রমে জিয়াউর রহমান, কে এম সফিউল্লাহ, খালেদ মোশাররফ, আবু তাহের, রফিকুল ইসলাম, মীর শওকত আলী, সি আর দত্ত, আবু ওসমান চৌধুরী (আগস্ট পর্যন্ত), এম এ মঞ্জুর, এম এ জলিল, এ এন এম নূরুজ্জামান, এম এ বাশার। উল্লেখ্য, ১৯৭৬ সালের ৪ জুলাই পেনসিলভানিয়ার ফিলাডেলফিয়ার দ্বিতীয় মহাদেশীয় কংগ্রেসে যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অনুমোদিত হয়। ১৭৭৬ সাল থেকে অদ্যাবধি স্বাধীনতার ১২১টি ঘোষণাপত্র প্রণয়ন করা হয়েছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রটি যুক্তরাষ্ট্রের ঘোষণাপত্রের আংশিক অনুকরণ করা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী কেবিনেটের সঙ্গে পরামর্শ-পূর্বক উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করেন এবং মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী, মনি সিং ও মোজাফ্ফর আহমদকে সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়।

স্বাধীনতার এই মহান ঘোষণাপত্রটি শুধু তৎকালীন সনদ বা দলিল নয়, বরং উক্ত ঘোষণাপত্রের তিন মূলনীতি বর্তমান ও ভবিষ্যতে বাঙালি জাতিকে স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি হিসেবে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে সহায়তা করবে। মনে রাখতে হবে, কোনো আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আসেনি, একটি সশস্ত্র যুদ্ধের মধ্য দিয়ে বিশ্বের মানচিত্রে স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় প্রিয় বাংলাদেশ। তাই গণতন্ত্র, সার্বভৌমত্ব, সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুশাসনের জন্য প্রতিটি নাগরিককে সচেতনতার সাথে সাহসী ভূমিকা পালন করতে হবে। এই প্রত্যাশায় শেষ করছি।

বিলাল হোসেন মাহিনী
নির্বাহী সম্পাদক : ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র, অভয়নগর, যশোর। ০১৯২২-৯৬৮২৯২

RELATED ARTICLES

Most Popular