Thursday, November 14, 2024
Homeচাকরিশিক্ষায় বৈষম্য : জাতীয়করণই সমাধান

শিক্ষায় বৈষম্য : জাতীয়করণই সমাধান

করোনা অতিমারির মধ্যেও দুর্বার গতিতে এগিছে চলেছে বাংলাদেশ। বিশেষতঃ বিগত প্রায় দেড় যুগে বাংলাদেশের অর্থনীতি, উন্নয়ন এবং জীবনযাত্রার মানে এসেছে দৃশ্যমান পবিবর্তন। এই দেড় যুগে আমাদের জাতীয় বাজেট বৃদ্ধি পেয়েছে কয়েকগুন। দেশের এই পরিবর্তনে সব সেক্টরের ন্যায় শিক্ষাও ভূমিকা রাখছে। শিক্ষায় বরাদ্দও বেড়েছে। কিন্তু অগ্রগতির মূল স্রোতে প্রবেশ করতে পারেনি শিক্ষক সমাজ। দেশের ৯৭ শতাংশ শিক্ষা এখনো বে-সরকারি তথা এমপিওভুক্ত। পত্র পত্রিকা ও শিক্ষক সংগঠনের বিবৃতি থেকে জানা যায়, এমপিওভুক্ত বে-সরকরি শিক্ষা এবং সরকারি স্কুল-কলেজ-মাদরাসা শিক্ষার মাঝে আকাশ-পাতাল বৈষম্য বিরাজমান। এছাড়াও দেশে রয়েছে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও আরও কয়েক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ প্রতি মাসে বেতন-ভাতা, বার্ষিক প্রবৃদ্ধি, বৈশাখী ভাতা এবং উৎসব ভাতা হিসেবে মূল বেতনের ২৫ শতাংশ অর্থ পান। কিন্তু নন-এমপিও শিক্ষকগণ এতোটুকু আর্থিক সম্মানি থেকেও বঞ্চিত।

বৈষম্যহীন শিক্ষা ছাড়া একটি জাতির সামগ্রিক উন্নয়ন-অগ্রগতির চিন্তা অমূলক ও অপ্রত্যাশিত। পৃথিবীর প্রায় সকল দেশে শিক্ষা ও শিক্ষকদের জন্য আলাদা পে-কমিশন থাকলেও বাংলাদেশ চলছে উল্টো রথে। এখানে শিক্ষা প্রশাসনের ক্যাডার কর্মকর্তাগণ এবং সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকগণ জাতীয় বেতন স্কেলে বেতন বোনাস, উৎসব ভাতা, চিকিৎসা ভাতাসহ অন্যান্য সকল সরকারি সুযোগ সুবিধা প্রাপ্ত হলেও বে-সরকারি তথা এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ চরম বৈষম্যের মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। সরকারি বে-সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জাতীয় শিক্ষা ক্রমের একই পাঠ্যবই ও সিলেবাসভুক্ত বিষয়াদি পঠন-পাঠনে যুক্ত থাকলেও তাদের মাঝে পাহাড়সম বৈষম্য। সরকারি নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েও বে-সরকারি এমপিওভুক্ত শিক্ষকগণ এখনো সিকি বোনাস পান, যা অত্যন্ত লজ্জার ও অপমানের। এনটিআরসিএ’র মাধ্যমে দেশের দূর-দূরন্তের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে নিয়োগ প্রাপ্ত হয়েও এমপিও শিক্ষকদের বদলির সুযোগ নেই; অধিকিন্তু তারা বাড়িভাড়া বাবদ মাত্র এক হাজার টাকা পান। মেডিকেল ভাতা মাত্র পাঁচ’শ টাকা। একটি মধ্যম আয়ের দেশে, বঙ্গবন্ধু কণ্যা শেখ হাসিনার ডিজিটাল বাংলাদেশে শিক্ষায় এমন বৈষম্য সত্যিই বে-মানান।

অবাক হওয়ার মতো বিষয় হলো, জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে বিরোধী দলীয় উপনেতা ও জাতীয় পার্টির চেয়ারম্যান জিএম কাদেরসহ অর্ধ ডজন এমপি মহোদয় বেসরকারি শিক্ষকদের শতভাগ উৎসব ভাতা প্রদানসহ দেশের সকল শিক্ষা প্রতিষ্ঠান জাতীয়করণের কথা তুলে ধরলেও মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী-প্রতিমন্ত্রী এমনকি খোদ মাননীয় প্রধানমন্ত্রী তাদের কথায় কর্ণপাত করেননি। দেননি কোনো সদুত্তর। যা শিক্ষকদের জন্য তথা শিক্ষার জন্য অপমান ও ব্যঞ্জনার।

আমাদের অনেক মন্ত্রী-এমপি মহোদয় দেশকে মাঝে মাঝে সিঙ্গাপুর কানাডার সাথে তুলনা করে বক্তব্য দেন। আর চিরশত্রু পকিস্তানের চেয়ে আমরা যে ঢের এগিয়ে তা বলতে তো দ্বিধাই করেন না। ভালো কথা। কিন্তু শিক্ষা ও শিক্ষক সমাজকে অর্থনৈতিকভাবে দুর্বল করে রেখে কাক্সিক্ষত উন্নয়ন ও দেশের সার্বিক অগ্রগতি সম্ভব কি? দেশের মানুষ গড়ার কারিগর শিক্ষকরা সংসার চালাতে হিমসিম খাচ্ছে। সংসারের ঘানি টানতে গিয়ে টাকার অভাবে তাদের চোখে অঝর ধারায় ঝরছে পানি।

অপ্রিয় হলেও সত্য, এদেশের সরকারি চাকরিজীবীদের মাসিক বেতন এবং মাসিক খরচের হিসাব মেলানো কঠিন। অনেকরই বেতনের চেয়ে বাসাভাড়া বেশি। সন্তানের লেখাপড়া, চিকিৎসা, বিনোদন, দৈনন্দিন খরচ ইত্যাদি তো রয়েছেই। তারপর বাড়ি গাড়ি আরও কত কী! এখন প্রশ্ন হচ্ছে এসব টাকার উৎস কী? সোজা উত্তর উপরি বা ঘুষ। দুর্নীতির রাহুগ্রাস তাদেরকে অন্ধ বানিয়ে ফেলেছে। সততা, কর্তব্যপরায়নতা, ন্যায়বোধ, দেশপ্রেম এখন সোনার হরিণ। এগুলো এখন একমাত্র জাদুঘরেই শোভা পায়। অবশ্য সৎ ও নিষ্ঠাবান কর্মকর্তা-কর্মচারি একেবারেই নেই তা বলছি না। তবে তাদের সংখ্যা অতি নগণ্য। মূলতঃ প্রশাসনে ঘাপটি মেরে থাকা এসব দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তা ও একশ্রেণির সুযোগ সন্ধানী শিক্ষক নেতাদের কারণে বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের বাংলাদেশ গড়ে তুলতে শেখ হাসিনা সরকারকে বেগ পেতে হচ্ছে। হচ্ছে না শিক্ষা জাতীয়করণ।

পত্র-পত্রিকা খবর উঠে এসেছে- ‘প্রতি বছরই শিক্ষা খাতের বাজেটকে আকারে বড় দেখালেও এমপিওভুক্ত শিক্ষক-কর্মচারীদের এখনো বাড়িভাড়া এক হাজার টাকা, চিকিৎসা ভাতা ৫০০ টাকা, এমপিওভুক্ত শিক্ষকের উৎসব বোনাস ২৫ শতাংশ, কর্মচারীর উৎসব বোনাস ৫০ শতাংশ এবং শিক্ষক-কর্মচারীরা জাতীয় বেতন স্কেলের অন্তর্ভুক্ত হলেও স্থায়ী পেনশন ব্যবস্থা আজো চালু হয়নি। এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের আয় সরকারি কোষাগারে জমা নিলে এবং শিক্ষার্থীদের বেতন কাঠামো একটু পরিবর্তন করলেই সরকারের চলমান মেয়াদেই এমপিওভুক্ত শিক্ষাব্যবস্থা জাতীয়করণ সম্ভব।

কোভিড-১৯ এর কারণে শিক্ষাব্যবস্থা আজ বিপর্যস্ত। ফলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের জীবন যাপন এতই কষ্টসাধ্য যা বর্ণনাতীত। বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা ২০০৪ সাল থেকে তথা ১৭ বছর ধরে উৎসব ভাতা পেয়ে আসছেন ২৫ শতাংশ শিক্ষক এবং ৫০ শতাংশ কর্মচারী। লক্ষ করা যাচ্ছে যেÑ ক, ১২ হাজার ৫০০ টাকা স্কেলের একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষক বোনাস পাচ্ছেন তিন হাজার ১২৫ টাকা। খ. ১৬ হাজার টাকা স্কেলের একজন স্নাতকোত্তর শিক্ষক বোনাস পাচ্ছেন চার হাজার ৬৩২ টাকা। গ. তৃতীয় শ্রেণীর এইচএসসি পাস একজন কর্মচারী বোনাস পাচ্ছেন পাঁচ হাজার ৩৯০ টাকা। ঘ. চতুর্থ শ্রেণীর অষ্টম শ্রেণী পাস একজন কর্মচারী বোনাস পাচ্ছেন চার হাজার ৭৮৫ টাকা। ঙ. সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের অষ্টম শ্রেণী পাস একজন কর্মচারী বোনাস পাচ্ছেন আট হাজার ২৫০ টাকা। এমপিওভুক্ত একজন এমএ পাস শিক্ষক একজন কর্মচারীর চেয়ে বোনাস কম পাওয়া খুবই লজ্জাকর এবং অমানবিক। মনে হচ্ছে, এমপিওভুক্ত শিক্ষা অভিভাবকহীন এবং যারা এমপিওভুক্ত শিক্ষা পরিচালনা করছেন তাদের কোনো দায় ও জবাবদিহিতা নেই। আজ মাধ্যমিক শিক্ষা আলাদা থাকলে এবং সেখানে এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের প্রতিনিধি থাকলে বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীদের এমন পরিণতি হতো না। শিক্ষা ও অর্থ মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী ও সচিব এবং প্রধানমন্ত্রীর কাছে বিগত দিনে বহুবার এমপিওভুক্ত শিক্ষক নেতারা স্মারকলিপি ও আবেদন জমা দিলেও তার কোনো প্রতিকার আদৌ হয়নি। তবে শিক্ষকদের বিশ্বাস ছিল, মুজিব শতবর্ষে এবং স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে বোনাস শতভাগ হবে এবং দীর্ঘদিনের প্রাণের দাবি এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ করা হবে। কিন্তু জাতীয়করণ আদৌ করা হলো না।

বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা গত ঈদের আগে সোশ্যাল মিডিয়া, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় স্মারকলিপি ও আবেদনের মাধ্যমে সরকারকে জানিয়ে দিয়েছেন, তারা ঈদুল ফিতরের আগেই শতভাগ বোনাস চান। বিষয়টি সরকার নিশ্চিত না করায় বেসরকারি শিক্ষক-কর্মচারীরা ক্ষুব্ধ হয়ে প্রতীকী আন্দোলনের অংশ হিসেবে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে পবিত্র ঈদুল ফিতরের নামাজ আদায় পূর্বক মানববন্ধনের মাধ্যমে শত ভাগ বোনাস প্রাপ্তির দাবিটি সরকারের কাছে পৌঁছানোর জন্য সাংবাদিক বন্ধুদের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। কিন্তু ফলাফল শুন্য। কোভিড-১৯ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় এবং টেকসই শিক্ষাব্যবস্থা প্রবর্তনের লক্ষ্যে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত নন-এমপিও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে এমপিও এর আওতায় আনা এখন সময়ের দাবি। অনার্স-মাস্টার্স কলেজের শিক্ষকদেরকে এমপিওভুক্ত করা অতীব প্রয়োজন। জাতীয়করণে অর্থ সংস্থানের ক্ষেত্রে শতভাগ উৎসবভাতা বাস্তবায়ন কমিটির নেতাদের প্রস্তাব হলোÑ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের যাবতীয় আয় যেমন রিজার্ভ ফান্ড, সাধারণ তহবিল, প্রতিষ্ঠানের পুকুর, জমি ও দোকান ভাড়ার টাকা সরকারি কোষাগারে যেন জমা নেয়া হয়। যদি সরকারি স্কুলে তৃতীয় থেকে পঞ্চম শ্রেণীর বেতন ৮ টাকার স্থলে ২০ টাকা করা হয়, ষষ্ঠ থেকে অষ্টম শ্রেণীর বেতন ১২ টাকার স্থলে ৩০ টাকা করা হয়, নবম থেকে দশম শ্রেণীর বেতন ১৮ টাকার স্থলে ৪০ টাকা করা হয় এবং কলেজ শিক্ষার্থীদের বেতন ২৫ টাকার স্থলে ৫০ টাকা করা হয়, তবেই এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ করা সম্ভব।

বিশেষভাবে উল্লেখ্য, এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণের বিষয়টি নিশ্চিত করতে এ সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের প্রয়োজন এবং প্রধানমন্ত্রীর একক সিদ্ধান্তের মাধ্যমেই বিষয়টি নিষ্পত্তি হতে পারে। উৎসবভাতা বাস্তবায়ন কমিটির নেতাদের মনে-প্রাণে দাবি, প্রধানমন্ত্রী যেনো তার এ ক্ষমতা বলেই এমপিওভুক্ত শিক্ষা জাতীয়করণ করেন, তখন শিক্ষাব্যবস্থা এগিয়ে যাবে এবং মেধাবীরা শিক্ষকতায় আকৃষ্ট হবে। ফলে দ্রুত এগিয়ে যাবে বাংলাদেশ, লাখো কোটি শিক্ষার্থী একই মানের সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পড়ালেখা করবে, অভিভাবকদের অর্থ সাশ্রয় হবে এবং নিশ্চিত হবে আলোকিত শিক্ষা। (সূত্র : দৈনিক নয়াদিগন্ত)

বিলাল মাহিনী / পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা। প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, প্রতিষ্ঠাতা ও নির্বাহী সম্পাদক : সিংগাড়ী আঞ্চলিক গণগ্রন্থাগার ও ভৈরব সংস্কৃতি কেন্দ্র। জীবন সদস্য- নওয়াপাড়া ইনস্টিটিউট, অভয়নগর, যশোর ।

RELATED ARTICLES

Most Popular