অপর মানুষ ও জীবকে কতটুকু সুখে রাখতে পারছে তার ওপর নির্ভর করে আদর্শ মানুষের পরিচয়। মানুষ সামাজিক জীব। সমাজে উঁচু-নিচু আছে ও থাকবে। থাকবে বিত্তশীল ও দরিদ্র। মানুষে মানুষে মত ও পথের পার্থক্য থাকবে। সাদা-শ্যামলসহ বহুবর্ণের সমাহার ঘটবে। তাই বলে কী অহমিকা পুষতে হবে হৃদে। চলাফেরা আচার-আচরণে পৃথিবীর সব মানুষের সাথে সদ্ব্যবহার ও মিষ্টি মুখে কথা বলা সুন্দর চরিত্রের নিদর্শন। আদর্শ মানুষতো সেই ব্যক্তি, যার হাত ও কথা থেকে অপর ব্যক্তি নিরাপদ থাকে। অহংকার-অহমিকা ও ইগোমুক্ত জীবন যাপন করতে পারলে পৃথিবীকে শান্তির সবুজ ভূমে পরিণত করা সম্ভব।
অহংকার মারাত্মক সামাজিক ব্যাধি। যা মানুষের দুনিয়া ও আখিরাত ধ্বংস করে দেয়, মানুষকে হেদায়াত ও সত্যের পথ থেকে দূরে সরিয়ে গোমরাহীর দিকে নিয়ে যায়। অহংকারের কারণেই আযাযিল ‘বিতাড়িত শয়তানে’ পরিণত হয়েছে। অতীতে পৃথিবীর বহু সম্প্রদায় অহংকারের কারণে ধ্বংস হয়েছে। মানুষ সাধারণত ধন-সম্পদ, ইলম বা জ্ঞান, ইবাদত, প্রভাব-প্রতিপত্তি ও বংশ মর্যাদা ইত্যাদি নিয়ে অহংকার কওে থাকে। অথচ এগুলো সবই আল্লাহর নেয়ামত বা অনুগ্রহ। স্রষ্টার দেওয়া নেয়ামত বা অনুগ্রহ দ্বারা অহংকার করার প্রশ্নই আসে না। বরং বান্দার শুকরিয়া আদায় করা উচিত। অহংকারী ও দাম্ভিককে আল্লাহ তা’আলা পছন্দ করেন না।
পবিত্র কুরআনে বলা হয়েছে, ‘নিশ্চয়ই আল্লাহ অহংকারী দাম্ভিক লোককে পছন্দ করেন না।’ (সূরা লোকমান, আয়াত- ১৮)। অহংকার হলো- অন্যের চাইতে নিজেকে বড় মনে করা, সত্যকে দম্ভভরে প্রত্যাখ্যান করা এবং মানুষকে তুচ্ছ জ্ঞান করা। হজরত আব্দুল্লাহ ইবনে মসউদ রা. হতে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূল সা. বলেন, ‘যার অন্তরে বিন্দু পরিমাণ অহংকার থাকবে সে জান্নাতে প্রবেশ করবে না। রাসূল সা. এ কথা বললে, এক লোক দাঁড়িয়ে জিজ্ঞাসা করল, কোনো কোনো লোক এমন আছে, সে সুন্দর কাপড় পরিধান করতে পছন্দ করে, সুন্দর জুতা পরিধান করতে পছন্দ করে, এসবকে কি অহংকার বলা হবে? উত্তরে রাসূল সা. বললেন, আল্লাহ তা’আলা নিজেই সুন্দর, তিনি সুন্দরকে পছন্দ করেন। অহংকার হলো সত্যকে গোপন করা এবং মানুষকে নিকৃষ্ট বলে জানা। (সহীহ মুসলিম : ২৭৫)।
পৃথিবীতে অহংকারের পরিণতি লাঞ্ছনা ছাড়া আর কিছু নয়। যার অন্তরে যতটুকু অহংকার থাকবে, তার জ্ঞান ও বোধশক্তি ততটুকু হ্রাস পাবে। অহংকারী সকলের ঘৃণার পাত্র হিসেবে বিবেচিত হয়। মানুষ যখন অহংকারী হয়, তখন তার মধ্যে অসংখ্য গুনাহ ও দোষের সমাবেশ ঘটে। অহংকারীকে আল্লাহ তা’আলা তার শাস্তি দুনিয়াতেও দেবেন এবং পরকালেও দেবেন। রাসূল সা. বলেছেন, ‘একজন মানুষ সর্বদা অহংকার করতে থাকে। অতঃপর একটি সময় আসে তখন তার নাম অহংকারীদের খাতায় লিপিবদ্ধ করা হয়, তখন তাকে এমন আযাব গ্রাস করে, যা অহংকারীদের গ্রাস করছিল।’ (জামে তিরমিজি, হাদিস নং- ২০০০)। অহংকার জান্নাতে প্রবেশের প্রতিবন্ধক হবে। অহংকারীকে অপমান অপদস্ত করে জাহান্নামে প্রবেশ করানো হবে।
রাসূল সা. এক হাদিসে বলেছেন, ‘আমি কি তোমাদেরকে কারা জাহান্নামে যাবে তাদের বিষয়ে খবর দেব? তারা হলো, অহংকারী, দাম্ভিক ও হঠকারী লোকেরা।’ (সহিহ মুসলিম, হাদিস নং- ৭৩৬৬)। অহংকার করতে পারেন শুধু আমাদের স্রষ্টা। কেননা তিনি সর্বময় ক্ষমতার অধিকারী। রাসূল সা. বলেন, আল্লাহ তা’আলা বলেন, ‘অহংকার হলো আমার চাদর আর বড়ত্ব হলো আমার পরিধেয়। যে ব্যক্তি আমার এ দুটির যে কোনো একটি নিয়ে টানাটানি করবে আমি তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করব।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪০৯২)।
সমাজে এই রোগটি মহামারী আকারে ছড়িয়ে পড়ছে। সমাজে শান্তি, সম্প্রীতি ও সমৃদ্ধির বড় অন্তরায় হলো অহংকার; যা মানুষের মনুষ্যত্বকে ধ্বংস করে, জাগিয়ে তোলে হিংস্রতা। অহংকার থেকে বাঁচার জন্য সবচেয়ে উপকারী ও কার্যকর ওষুধ হলো আল্লাহর নিকট দোয়া ও সাহায্য চাওয়া। এ কারণে রাসূল সা. উম্মতকে দোয়া শিখিয়েছেন এবং তিনি নিজেও সালাতে বেশি বেশি করে আল্লাহর নিকট দোয়া করতেন।
এ প্রসঙ্গে হাদিসের এক বর্ণনায় এসেছে, হযরত যুবাইর ইবনে মুতইম রা. হতে বর্ণিত, তিনি রাসূল সা.-কে একবার সালাত আদায় করতে দেখেন, তখন তিনি রাসূল (সা.)-কে সালাতে এ কথাগুলো বলতে শোনেন, ..আমি বিতাড়িত শয়তান হতে তোমার নিকট আশ্রয় চাচ্ছি, আমি আরও আশ্রয় চাচ্ছি তার অহংকার থেকে তার প্ররোচনা ও ষড়যন্ত্র থেকে।’ (সুনানে আবু দাউদ, হাদিস নং- ৪৯০৫)
লেখক : বিলাল হোসেন মাহিনী,
পরীক্ষক : ইসলামি আরবি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা।
প্রভাষক : গাজীপুর রউফিয়া কামিল মাদরাসা, যশোর।