ফাইয়াজ তাইয়েব আহমেদের নিজের ফেইসবুকে দেওয়া পোস্টটি হুবহু তুলে ধরে হলো ;
এশিয়ান ক্লিয়ারিং ইউনিয়ন (আকু)’র পাওনা পরিশোধের পরেও বাংলাদেশের আনুমানিক ৯ মাসের আমদানি ব্যয়ের সমান রিজার্ভ রয়েছে। বেশি রিজার্ভ বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের সামর্থ্য বাড়ায়, তবে সরকার বৈদেশিক ঋণ নেয়ার হার বেশ ব্যাপক। আইএমএফ কান্ট্রি রিপোর্ট ১২/২৯৯ অনুসারে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ঋণ জিডিপি অনুপাত ছিল ৩২,৭%। কিন্তু নতুন আইএমএফ রিপোর্টে বলা হয়, ২০১৯ এর শেষে ঋণ জিডিপি অনুপাত দেশের ইতিহাসের রেকর্ড ৩৬ উঠে গিয়েছিল। করোনাকালীন সংকটে অতিরিক্ত ঋণ গ্রহনের মাধ্যমে ঋণ জিডিপি অনুপাত নতুন রেকর্ড ৪১ পর্যন্ত পৌঁছে যেতে পারে; আইএমএফ, ১২ জুন ২০২০)।
তবে অর্থনীতি সমিতি বলেছে, বাংলাদেশের মোট ঋণের পরিমাণ জিডিপির ৫৩ শতাংশের সমান হয়ে গেছে! সূত্র- ‘করোনার মহাবিপর্যয় থেকে মুক্তি ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বাংলাদেশ বিনির্মাণে ২০২০-২১ অর্থবছরের জন্য বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতির বিকল্প বাজেট প্রস্তাবনা’, অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত, ৮ জুন ২০২০।
ইআরডির হিসাবে বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ৪ হাজার ৪০৯ কোটি ৫১ ডলার, এই হিসাবে শুধু মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ ২৩৪২৫ টাকা। সরকারের অভ্যন্তরীণ ব্যাংক ঋণ প্রায় সাড়ে তিল লক্ষ কোটি টাকা যা প্রায় দেড় বছরের মোট রাজস্বের সমান। দেশী ও বেদেশী ঋণ মিলে মোট মাথাপিছু ঋণ ৭৯ হাজার টাকা। বিগত ১২ বছরে মাথাপিছু বৈদেশিক ঋণ বেড়েছে প্রায় সাত গুণ।
অভিযোগ আছে যে, সরকার, গ্রেস পিরিয়ড শেষ না হওয়া বৈদেশিক ঋণ আউন্টস্ট্যান্ডীং ঋণ হিসেবে দেখায় না। বাংলাদেশ ব্যাংকের পাবলিক ডেটায় এখন বৈদেশিক ঋণ ৩৭,৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের দেখালেও অভ্যন্তরীণ ডকুমেন্টে প্রায় ৬৫ বিলিয়ন ডলারের উপর বৈদেশিক ঋণের তথ্য আছে। একইভাবে অভ্যন্তরীণ ঋণ এক লক্ষ ৬৮ হাজার কোটি দেখানো হলেও বাস্তব ঋণ প্রায় সাড়ে তিন লক্ষ কোটি। প্রভিডেন্ট ফান্ড, স্ব শাসিত কোম্পানির ফান্ড, বন্ড থেকে নেয়া ঋণকেও ঋণ দেখানো হয় না প্রায়ই। এতে সরকারি হিসাবে ঋণ-জিডিপি অনুপাত অনেক কম দেখানো যায়।
(উল্লেখ্য যে, ২০১৯-২০ ও ২০-২১ অর্থবছর দুটিতে ৫ লক্ষ কোটি নতুন অর্থ সরবারহ বা টাকা ছাপিয়ে ঋণ দেয়ার হিসাব এর বাইরে, যা সরকার ও বাণিজ্যিক ব্যাংক গুলা মিলে বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে ঋণ করেছে। যদিও আমরা জানি এর উল্লেখযোগ্য ঋণ কখনই ফিরবে না, ফলে একচুয়াল সরকারি ঋণ সাড়ে তিল লক্ষেরও অনেক বেশি হবে)।
শুধু ২০২০ সালে বাংলাদেশ সোয়া সাত বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিদেশী ঋণ করেছে। কিন্তু বাংলাদেশ ব্যাংকের এক্সটার্নাল ডেবট টেবিলের (ওয়েব সাইটে) তথ্যের এর কোন হসিদ নাই। এদিকে অতি উৎসাহী কিছু আমলা এখনও ঋণ-জিডিপি অনুপাত ১৫ এর মত বলে রাতকে দিন বানানোর মত মিথ্যা ছড়াচ্ছে। এখনও ঋণ-জিডিপি অনুপাতকে সাস্টেইনেবল বলার মিথ্যা ও অদুরদর্শিতা থেকে সরকার সরছে না। অতি উৎসাহীরা মোট ঋণ নয়, বরং শুধু “বৈদেশিক ঋণ ও জিডিপির” অনুপাত নাকি ৪০ এ নিতে চান, অন্তত ডেটা না লুকিয়ে, কথা বলেন! ৩২০ বিলিয়ন ডলারের জিডিপিতে আপনি সরকারের ব্যয় আর এডিপি করতে ৫০-৫৫ বিলিয়ন ডলারের লোকাল ঋণ করে বসে এর উপর আবার জিডিপি’র ৪০% বৈদেশিক ঋণ করতে চান, দেশটাকে কি লুটের বস্তা পাইসেন?
প্রতিবারই নতুন বৈদেশিক ঋণ থেকে আগের ঋণের মোট সুদ বাদ দিয়ে নতুন ঋণের একটা মিথ্যা “নিট” পরিমাণকে সামনে হাজির করা হয়। এই রকম জোচ্চুরি আর কত? একই ভাবে অভ্যন্তরীণ ব্যাংক, সঞ্চয় পত্র ঋণ থেকেও আগের ঋণ হাজার হাজার কোটি টাকা বিয়োগ করে একটা ছোট পরিমাণকে ‘নীট’ হিসেবে দেখানোর অপ তৎপরতা চলে আসছে।
এতদিন বলা হত, বাংলাদেশের ঋণ-জিডিপি অনুপাত কম, বলে বৈদেশিক ঋণ নেয়া যাবে। কিন্তু এটা রিস্কি মার্জিন ৪০ পৌঁছেছে বা ছাড়িয়েছে। সুতরাং সাবধান হবার সময় হয়েছে। ঋণ করে ঘী খাবার মাশুল গ্রীস, পাকিস্তান ও শ্রিলংকা টের পাচ্ছে। বাংলাদেশের ঋণ করে ঘি খাবার নেশায় লাগাম দরকার। ঋণের টাকায় চালিত প্রকল্প একদিকে ঠিক সময়ে বাস্তবায়ন হচ্ছে না, ঋণ নির্ভর প্রকল্পের ক্রয়/খরচ বা ব্যয়ের মডেল ভয়ঙ্কর রকমের দুর্নীতি গ্রস্ত। ঋণ নির্ভর প্রকল্পে দুর্নীতির মচ্ছব এতই যে, শুধু লুটের জন্যই ইচ্ছাকরে সময় ক্ষেপণ করা হয় এবং প্রকল্পের ব্যয় বৃদ্ধি করা হয়।
আমাদের কাজ সতর্ক করে যাওয়া। সতর্ক রেখা টানার কাজটা আমরা করে যাচ্ছি। সাধু সাবধান। ইতিমধ্যেই নতুন প্রকল্পের বৈদেশিক ঋণের হার খুব বেড়েছে, যেখেনে বিশ্ব ঋণাত্মক ঋণের দিকে হাঁটছে। শুধু ঋণের সুদ প্রদান একটা দেশের বাজেটের ২য় সর্বোচ্চ বরাদ্দ খাত, এটা বাংলাদেশ!
কারণ ঋণদাতা সংস্থা বা দেশ বাংলাদেশের একুয়াল ঋণ মান জানেন। এখানে ধুনফুন আর ডেটা চুরি চলে না।
মাথাপিছু ঋণ বাড়ার পাশাপাশি, এর আরেকটা অর্থ আছে। ৪০ বছর ধরে সতর্কতার সাথে ধরে রাখা বৈদেশিক ঋণমান ভাঙ্গিয়ে ফেলায়, নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ প্রকল্প করা মুশকিল হয়ে পড়বে। ২য় পদ্মা সেতু, ২য় যমুনা, পদ্মা রেল সেতু, যমুনা রেল সেতু, ঢাকা চট্রগ্রাম সরাসরি ইলেকট্রিক ট্রেন, সব বিভাগীয় শহরে মেট্রো, বাংলাদেশ ডেল্টা প্লান, জলবায়ু ঝুঁকির অবকাঠামো, কৃষি মতস ও খাদ্য প্রক্রিয়াজতকরণ, বিগ ডেটা, স্মার্ট কন্ট্রাক্ট ব্লকচেইন প্রযুক্তির অবকাঠামো সহ বহু প্রকল্প বাকি আছে। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে ঠকিয়ে ঋণ নিয়ে সঠিক সময়ে প্রকল্প অন এয়ার করার ঝোঁকের চেয়ে আমরা দেখি প্রকল্প ব্যয় বাড়ানো আর লুটের ঝোঁকই বেশি।
উল্লেখ্য, ফাইয়াজ তাইয়েব আহমেদ টেকসই উন্নয়ন নিয়ে নিয়মিত গবেষণা ও লেখালেখি করছেন। গত বই মেলায় তার ‘ চতুর্থ শিল্প বিপ্লব ও বাংলাদেশ ‘নামে একটি বই বেরিয়েছে। যা বেশ জনপ্রিয়।